June 6, 2008

লাউয়াছড়া

রো না ল্ড হা ল দা র

এ রকম অল্প জায়গায় এত প্রাণবৈচিত্র্য ভরা বন বাংলাদেশের আর কোথাও চোখে পড়ে না। আধা চিরসবুজ এ বনের কিছু অংশ মানবসৃষ্ট হলেও প্রাকৃতিক বনের অনেক কিছুই এখনো রয়ে গেছে। বর্তমানে এ বনের আয়তন এক হাজার ২৫০ হেক্টর। ১০০ বছর আগে এ বনের পরিধি ছিল আরও অনেক বেশি। লাউয়াছড়ার পাশেই একটি ছোট্ট বন আছে, সাতছড়ি। এটিও আগে লাউয়াছড়ার সঙ্গে যুক্ত ছিল। পুরো এলাকাতেই ছিল এ রকম বন। বন কেটে চা বাগান করার ফলে পরিধি অনেক কমে যায়। তারই খন্ডবিশেষ হচ্ছে এই লাউয়াছড়া।
প্রাণবৈচিত্র্যের দিক থেকে লাউয়াছড়ার গুরুত্ব অনেক। পাখিই আছে প্রায় ২৪৬ রকমের। এদের মধ্যে কিছু আছে পরিযায়ী পাখি যেগুলো গ্রীষ্ক্নে এখানে আসে, বাসা বাঁধে, ডিম পাড়ে, বাচ্চা ফোটায়। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হুডেড পিটা। আরও আছে ধনেশ, ব্লু পিটা, ব্ল্যাক বাজা, ব্লাইকস বাজা, পেঁচা, মথুরা প্রভৃতি। প্রাকৃতিক বন না হলে এরা থাকবে না।
লাউয়াছড়ায় প্রায় ১৬ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী দেখা যায়। উল্লেখযোগ্য উল্লুক, ভালুক, চশমা পরা হনুমান, পিকটেইল বানর, রেসাস বানর। আরও আছে মায়াহরিণ, সজারু, শুকর, বনবিড়াল। এখানে কাঁকড়া খেয়ে জীবন ধারণ করে এ রকম বিলুপ্তপ্রায় বেজি দেখা যায়। অন্য কোথাও এর দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। লাউয়াছড়ায় তিন ধরনের কাঠবিড়ালি চোখে পড়ে, যা অন্য বনে সচরাচর দেখা যায় না। কালো টুপি হনুমানও এ বনের এক উল্লেখযোগ্য প্রাণী। চশমা পরা হনুমান, কালো টুপি বানর ও উল্লুক−তিনটি প্রাণীই প্রায় বিলুপ্তির পথে।
লাউয়াছড়া ধ্বংস হয়ে গেলে এ ধরনের জীববৈচিত্র্য বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাবে। এ জন্য এ বনটা রক্ষা করা জরুরি। আর প্রাণবৈচিত্র্য আমাদের গচ্ছিত সম্পদ। কোনটা কখন মূল্যবান হয়ে দাঁড়াবে, বলা যায় না। বনমোরগ থেকেই কিন্তু পোলট্রি শিল্পের শুরু। বাজারে যেসব অর্কিড পাওয়া যায়, এদের আদি উৎস লাউয়াছড়ার মতো বন। এখানে অনেক ধরনের অর্কিড পাওয়া যায়। এ বনের বহু ধরনের লতাগুল্ম আয়ুর্বেদিক ওষুধ হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। এখানে এমন অনেক ওষুধি বৃক্ষ আছে, যেগুলোর ওষুধি মূল্য আমরা জানিও না।
সরকার লাউয়াছড়া বনকে সংরক্ষিত ঘোষণা করেছে। একে নিসর্গ প্রকল্পের আওতায় আনা হয়েছে। স্থানীয় গাইডদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, হাঁটার জন্য ট্রেইল করা হয়েছে, আশপাশের মানুষকে বনের সংরক্ষণের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। সবই ভালো উদ্যোগ। কিন্তু মানুষ নিয়ন্ত্রণে এ প্রকল্প ব্যর্থ হয়েছে। অনেক মানুষ একসঙ্গে ঢুকে বনটিকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। দর্শনার্থীরা যেদিকে ইচ্ছা সেদিকে ঢুকে পড়ছে; খাবারের প্যাকেট, পানির বোতল ও উচ্ছিষ্ট ফেলছে। এসব নিয়ন্ত্রণে কোনো ব্যবস্থা নেই। বন রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে যাঁরা আছেন, পর্যটনব্যবস্থাপনায় তাঁদের আরও উদ্যোগী হতে হবে। এত ছোট বনে এত বেশি মানুষ ঢোকার কোনো সুযোগ নেই। প্রবেশমূল্য ধরা হলে হয়তো দর্শনার্থীদের সংখ্যা কমে যাবে। বনের ভেতর পিকনিক নিষিদ্ধ করতে হবে। বাইরে পিকনিক করার জায়গা অনেক আছে। আর দর্শনার্থীরা কোথায় ঢুকতে পারবে, কোথায় পারবে না−এটিও নির্ধারণ করে দিতে হবে।
শেষ পর্যন্ত লাউয়াছড়াকে বাঁচানোর দায়িত্ব কিন্তু বন বিভাগেরই। কিন্তু এখন পর্যন্ত বনের গাছ চুরি রোধ করতে পারেনি তারা। এ জন্য আরও নজরদারি বাড়াতে হবে। বনের চারপাশের অবস্থাও খুব খারাপ। অনেক জায়গায় গাছ কেটে সাফ করে ফেলেছে মানুষ। এসব জায়গায় বন্যপ্রাণীদের উপযোগী দেশি প্রজাতির গাছের চারা লাগাতে হবে। এসব বিষয়ে এখনই সচেতন হলে ১৫-২০ বছরের মাথায় লাউয়াছড়া একটি বড় প্রাকৃতিক সম্পদ হয়ে দাঁড়াবে।
----------
প্রথম আলো। ৬ জুন ২০০৮

0 comments:

Post a Comment