June 6, 2008

মধুপুর শালবন

সৈ য় দা রে জো য়া না হা সা ন

শালগাছ বেশি। তা থেকেই নাম হয়েছিল শালবন। এ বন থেকেই জীবিকা নির্বাহ করত গারোসহ অন্যান্য স্থানীয় আদিবাসী। প্রতিদিনের আহার থেকে শুরু করে রোগ নির্মূলের ওষুধ পর্যন্ত সবই তাদের জোগান দিত এ বন। নিজেদের প্রয়োজনেই তাই বন রক্ষা করে চলত তারা। ফলে যুগের পর যুগ নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়েই টিকে ছিল এ বন। প্রাণীদের বঞ্চনা করত না মধুপুর। এ সবই এখন ইতিহাস।
নামে শালবন থাকলেও শালগাছ বিলুপ্তপ্রায়। তার জায়গা দখল করেছে নানা জাতের বিদেশি বৃক্ষ। স্থানীয় আদিবাসীরাও বনের ওপর থেকে অধিকার হারিয়েছে। বনে প্রবেশের অপরাধে তাদের বিরুদ্ধে দেওয়া হয়েছে শত শত মামলা। বনের ওপর অধিকার চেয়ে আন্দোলনরত আদিবাসীরা নানা সময় পত্রপত্রিকার শিরোনাম হয়েছে। কিন্তু কোনো ফল আসেনি। স্থানীয় অধিবাসীদের বন থেকে যত দুরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, তত বেড়েছে ধ্বংস। প্রতিবছর বাড়ছে বেহাত হওয়া জমির পরিমাণ। সব মিলিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম্যে মধুপুর বন এখন বিপর্যস্ত।
২০ হাজার একরের ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানসহ কাগজেকলমে মধুপুর বনের আয়তন এখনো ৪৫ হাজার একর। তবে বর্তমানে সরকারের দখলে আছে মোটে সাত-আট হাজার একর। তার মধ্যে আড়াই হাজার একর সংরক্ষিত বন। কিন্তু সরকারের কাগজেকলমে তৈরি করা নিয়ম কেউ মানছে না। বনের মধ্যে শহর গড়ে উঠেছে। তৈরি করা হয়েছে হাজার হাজার শিল্প প্রতিষ্ঠান। অবাধে তৈরি করা নানা স্থাপনার ভিড়ে শালবনকে এখন বন হিসেবে চিহ্নিত করাই মুশকিল। হঠাৎ দেখে শহর ও শিল্প এলাকার মধ্যে সামান্য বনভুমি ভাবলে খুব একটা ভুল হবে না।
একসময় জীববৈচিত্র্যের আধার ছিল এ বন। ছিল নানা জাতের ওষুধি গাছ। ঢাকা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল প্রভৃতি বড় শহরের কাছে হওয়ায় পুরো এলাকার পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায়ও রাখত ভুমিকা। আর এখন তো বলা হচ্ছে, বিশ্বজুড়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও কার্বনের বিষ কমানোর ক্ষেত্রে শালবন বিশেষ ভুমিকা রাখতে পারে। তাই শালবন ধ্বংস হলে তা শুধু বনের ক্ষতি না, সামগ্রিকভাবে পরিবেশের ভারসাম্যও নষ্ট হবে।
এ ধরনের অবস্থা ভারত ও নেপালেও হয়েছিল। সে দেশগুলোর সরকার বনব্যবস্থাপনার নতুন নিয়ম করে ধ্বংস হওয়া বন আবার ফিরে পেয়েছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশের বনব্যবস্থাপনায় যে নিয়ম চলছে তার উল্টো পদ্ধতিতে। বনের ওপর স্থানীয় মানুষের অধিকার নিশ্চিত করে আইন তৈরি করেছে ভারত। বনজীবীদের ওপর যে অবিচার করা হয়েছে তা রোধ করতেই এ আইন। স্থানীয় জনগণ বনের জমিতে চাষাবাদ, কাঠ ও অন্যান্য সম্পদ সংগ্রহের অনুমোদন পেয়েছে। সবাই বলেছিল এতে চিরতরে ধ্বংস হয়ে যাবে বন। হয়েছে উল্টো। স্থানীয় জনগণ ধ্বংস হওয়া বনের ৯০ ভাগ আবার ফেরত এনেছে। বনের সম্পদ টিকিয়ে রেখেই সম্পদ আহরণ করছে তারা।
আমাদের শালবনসহ অন্যান্য বনের ক্ষেত্রেও একই ধরনের ব্যবস্থাপনা হতে পারে। বনব্যবস্থাপনার নীতি ও পরিকল্পনা তৈরি করবে স্থানীয় জনগণ। বন রক্ষার জন্য প্রহরী দরকার নেই। স্থানীয় মানুষই তাদের সম্পদ পাহারা দেবে। তবে এ জন্য বনের ওপর স্থানীয় মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। সরকার শুধু পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করবে। ছয় মাস বা এক বছর পরপর বনের পরিস্িথতি পর্যবেক্ষণ করে প্রতিবেদন তৈরি করবে। সরকার এখানে কোনো হস্তক্ষেপ করবে না।
এভাবে আমাদের হারিয়ে যাওয়া শালবনের ৩০ থেকে ৩৫ হাজার একর আবারও ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এ জন্য সরকারকে শুধু উদ্যোগী হতে হবে। আমাদের দেশের যে বন আইন আছে, তার মধ্যেই স্থানীয় জনগণকে যুক্ত করার সুযোগ রয়েছে। বনের একেকটি এলাকা ধরে বনগ্রাম করা যেতে পারে। বনের ওপর বন বিভাগের একচ্ছত্র আধিপত্য কমাতে হবে। অস্ত্রসহ নিরাপত্তা প্রহরীর ধারণা বাদ দিয়ে সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। তবেই আবার নতুন জীবন পাবে মধুপুর শালবন।
-----------
প্রথম আলো। ৬ জুন ২০০৮

0 comments:

Post a Comment