June 6, 2008

উপকুলীয় বনাঞ্চল

ই ক লি ল ম ন্ড ল

পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে। এ যাত্রায় নদীগুলো প্রতিবছর দুইশ চল্লিশ কোটি টন পলি বহন করে। সাগরে পড়ার সময় নদীগুলোর স্রোতের বেগ কম থাকায় ওই পলি সহজেই মোহনায় জমে সৃষ্টি করে নতুন নতুন চর। তবে সব চরই যে স্থায়ীভাবে ভুমির রূপ ধারণ করে তা কিন্তু নয়। কারণ এসব চরে ভুমি গঠন এবং ভুমিক্ষয়ের মতো ভাঙাগড়ার খেলা চলতে থাকে। ফলে একদিকে যেমন নিত্য-নতুন চর জেগে উঠছে, অন্যদিকে অনেক চর ভেঙেও যাচ্ছে। চরের এ ভাঙাগড়ার মধ্যেই গড়ে ১০ বর্গকিলোমিটার ভুমি জেগে উঠছে প্রতিবছর। প্রাথমিকভাবে চরের ভুমির স্থায়িত্ব তেমন থাকে না। ফলে এটির যত্নের প্রয়োজন আছে। তখনই এর দায়িত্ব দেওয়া হয় পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের কাছে। নদীর মোহনায় এসব মাটিকে সুসংহত করার জন্য বনায়ন ব্যতীত অন্য কোনো বিকল্প নেই। স্বাভাবিকভাবেই বন মন্ত্রণালয় সেদিকেই যায়। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় উপকুলীয় পরিবেশে কোন ধরনের গাছ লাগানো হবে? সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনায়ন থেকেই মূলত তারা ধারণাটি পায়। সেটাই প্রয়োগের মধ্য দিয়েই ’৬০ সালে বাংলাদেশে উপকুলীয় বনাঞ্চলের ধারণাটা শুরু হয়। শুরু হয় পটুয়াখালী ও নোয়াখালীতে এ উপকুলীয় বনাঞ্চল করা। ’৭০ সালের ঘুর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পর থেকে সরকার উপকুলীয় বনায়নকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়। সে সময় বন বিভাগ প্রাথমিকভাবে সরকারের অর্থায়নে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধের বাইরে বারোপিট বাঁধের জন্য মাটি তোলা হলে যে গভীর জায়গা হয়, সেখানে সীমিত আকারে উপকুলীয় বন করা শুরু করে। ’৭৪ সালে এ বনায়ন কার্যক্রম সম্প্রসারিত হয় জোয়ারপ্লাবিত চরভুমিতে। বন বিভাগের সাফল্য বিবেচনা করে আশির দশকে এগিয়ে আসে বিশ্ব ব্যাংক। তাদের অর্থায়নে বন বিভাগ ম্যানগ্রোভ বনায়ন প্রকল্প, দ্বিতীয় বন প্রকল্প এবং বনজ সম্পদ ব্যবস্থাপনা নামে তিনটি প্রকল্প হাতে নেয়।

সুন্দরবনকে বাদ দিয়েই বাংলাদেশের উপকুলীয় বনাঞ্চলের মোট আয়তন দেড় লাখ হেক্টর। মূলত পটুয়াখালী, নোয়াখালী, ভোলা ও চট্টগ্রাম−এ চারটি বিভাগে ভাগ করে উপকুলীয় বনাঞ্চলের কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এসবের অধীনে বরগুনা, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, সীতাকুন্ড, কক্সবাজার, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা জেলাও রয়েছে। লবণাক্ততা, জোয়ার-ভাটার প্রকোপ এবং মাটির গুণাগুণ বিবেচনা করে বনায়নের জন্য ম্যানগ্রোভ প্রজাতি নির্বাচন করা হয়ে থাকে। উপকুলীয় বনাঞ্চলের প্রধান প্রজাতি হচ্ছে কেওড়া। এটি উপকুলীয় বনাঞ্চলের ৯৭ শতাংশ জায়গাজুড়ে রয়েছে। তা ছাড়া অন্যান্য প্রজাতির মধ্যে রয়েছে বাইন, কাকড়া, গোলপাতা ও গেওয়া। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য সরকার নোয়াখালী উপকুলীয় বন বিভাগের নিঝুম দ্বীপ এবং ভোলা উপকুলীয় বন বিভাগের চরকুকরী-মুকরীকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছে। এসব জায়গায় বিভিন্ন উদ্ভিদের পাশাপাশি রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির দেশি-বিদেশি পাখি এবং অসংখ্য হরিণ। কাঠ, জ্বালানি কাঠ, ঘরের ছাউনি সরবরাহ করা ছাড়াও উপকুলীয় বন মাছসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণীর প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবেও কাজ করে থাকে।

উপকুলীয় বনাঞ্চল নানাভাবে মানুষের উপকারে এলেও এর সংরক্ষণে কিছুটা উদাসীনতা দেখা যায়। উপকুলীয় বনাঞ্চল তথা চরের মালিকানা প্রথম ২০ বছর বন বিভাগের হাতে থাকার পর নিয়মানুযায়ী হস্তান্তর করতে হয় ভুমি মন্ত্রণালয়ের কাছে। ভুমি মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে বিভিন্ন ব্যক্তি লিজ নিয়ে চিংড়ি চাষ ও অন্যভাবে উপকুলীয় বনাঞ্চলকে ধ্বংস করে ফেলে। এভাবে তো চরবাটার প্রায় ২০ হাজার একর জমি ভুমিদস্যুদের দখলে চলে গেছে। উপকুলীয় জমি এক ফসলী হওয়ায় অনেকে চিংড়ি চাষের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এতে তাদের স্বল্পমেয়াদি লাভ হলেও ভুমির কিন্তু ক্ষতি হয়ে যায় দীর্ঘমেয়াদি। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় এ ধরনের চিংড়ির চাষ করা হয়েছিল। পরে এসব বন্ধ করে দিয়ে দেশগুলো চিংড়ির ঘেরগুলোয় আবার বনায়ন করেছে। আমাদের তা থেকে শিক্ষা নেওয়ার প্রয়োজন আছে বইকি। এ জন্য প্রয়োজনে ভুমি মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের একসঙ্গে বসে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া।
------------
প্রথম আলো। ৬ জুন ২০০৮

0 comments:

Post a Comment