June 6, 2008

সুন্দরবন

আ ব্দু র র হ মা ন
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে আছে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত এ বন। বাংলাদেশ অংশের আয়তন প্রায় ছয় হাজার বর্গ কিলোমিটার, যা মোট আয়তনের ৬২ শতাংশ। সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও খুলনা−এই তিন জেলাজুড়ে আধিপত্য বিস্তার করলেও পটুয়াখালী আর বরগুনায়ও সুন্দরবনের কিছু অংশ পড়েছে।
অবস্থানগত কারণে গ্রীষ্ক্নমন্ডলীয় বিশ্বের মোট সাইক্লোনের ১৭ শতাংশই হয় বঙ্গোপসাগরে। যুগ যুগ ধরে এসব সাইক্লোনের হাত থেকে উপকুলীয় মানুষকে রক্ষা করে আসছে সুন্দরবন। যেমনটা করেছে গত ১৫ নভেম্বর।
সুন্দরবনের ইতিহাস বহু প্রাচীন। এটি প্রথম ব্যবস্থাপনার আওতায় আসে ১৮৭৫ সালে। ১৮৭৯ সালে একে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা করে ব্রিটিশ সরকার। ১৮৯৩-৯৪ সালের দিকে ইংরেজ বনকর্মকর্তা হ্যানিং ১০ বছর পালা ধরে নতুন একটি ব্যবস্থাপনা চালু করেন। আর সুন্দরবনে এখন যে ব্যবস্থাপনা কার্যকর আছে, তা তৈরি করেন কেনানিজাডো ও হুসেন, ১৯৯৮ সালে।
চারটি রেঞ্জে বিভক্ত পুরো সুন্দরবন: শরণখোলা, চাঁদপাই, খুলনা ও সাতক্ষীরা। রক্ষণাবেক্ষণের সুবিধার জন্য এই চারটি রেঞ্জকে আবার ৫৫টি কম্পার্টমেন্টে ভাগ করা হয়েছে। সুন্দরবনের মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে পশুর, শিবসা, রায়মঙ্গলসহ অসংখ্য নদ-নদী। এগুলোর বয়ে আনা স্বাদু পানি আর বিপরীত দিক থেকে আসা সমুদ্রের লোনা পানির কারণে সুন্দরবনের একেক অংশের মাটি একেক রকম। পানির লবণাক্ততার ওপর ভিত্তি করে সুন্দরবন তাই তিনটি এলাকায় বিভক্ত। যেখানে মিঠা পানির প্রবাহ বেশি, সেটি মিঠা পানি অঞ্চল। সুন্দরবনের পূর্ব ও উত্তর অংশ−পুরো জঙ্গলের প্রায় অর্ধেক−এই অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। এখানে সুন্দরীগাছের আধিক্য যেমন বেশি, তেমনি গাছের বৃদ্ধিও বেশি। এই অঞ্চলের নদীতীর ঘেঁষে দেদার জন্েন গোলপাতা। পুরো সুন্দরবনের মধ্যে উদ্ভিদ ও প্রাণীবৈচিত্র্যে সবচেয়ে সমৃদ্ধ এ অঞ্চল। মিঠা পানি অঞ্চলের দক্ষিণ-পশ্চিমে মৃদু লবণাক্ত পানির অঞ্চল। এখানকার প্রধান বৃক্ষ গেওয়া। আর লবণাক্ত পানির অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি জন্েন গরান।
দিনে দুবার জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয় এই বন। এ সময় পানিতে তলিয়ে যাওয়া সুন্দরী, গেওয়া, কেওড়া, বাইন, পশুর প্রভৃতি গাছ ছিদ্রযুক্ত শ্বাসমূলের সাহায্যে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সংগ্রহ করে। আবার ঝানা, গর্জনের মতো বিশেষ কিছু উদ্ভিদ ফল গাছে থাকা অবস্থায় অঙ্কুরোদগম করে। মাটিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই এটি সেখানে পাকাপোক্তভাবে গেড়ে বসে। পানির টানে যেন ভেসে যেতে না পারে, সে জন্যই প্রকৃতিপ্রদত্ত এই ব্যবস্থা।
উদ্ভিদ ও প্রাণীবৈচিত্র্যে অনন্য এক বন সুন্দরবন। এই বনে আছে ৩৩০ প্রজাতির উদ্ভিদ, ২৭০ প্রজাতির পাখি, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৩২ ধরনের চিংড়ি এবং ১৭৭ প্রজাতির মাছ। সুন্দরবনের মোট বৃক্ষাচ্ছাদিত অরণ্যের ৭৩ শতাংশজুড়েই আছে সুন্দরীগাছ।
সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ রয়েল বেঙ্গল টাইগার। এই বাঘ একদিকে যেমন পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ, অন্যদিকে তেমনি বনের রক্ষাকবজও। শত শত বছর ধরে অনুপ্রবেশকারী আর বনদস্যুদের কবল থেকে সুন্দরবনকে রক্ষা করে আসছে এরা। এই বনে হরিণ আছে দুই রকম−চিত্রা আর মায়া। সুন্দরবনের জল ও ডাঙ্গায় আরও আছে বন্য শুকর, মেছোবাঘ, বানর, চিতা-বিড়াল, গুইসাপ, অজগর, উদ্বিড়াল, কুমির, ডলফিন, কিং কোবরা।
বঙ্গোপসাগরের মৎস্য সম্পদের প্রধান কারণও সুন্দরবন। বনের গাছপালা থেকে ঝরে পড়া পাতা, ডাল ইত্যাদি পচা-অর্ধপচা অবস্থায় সাগরে ভেসে গিয়ে মাছের খাবার হয়। বঙ্গোপসাগরের অনেক মাছ ডিম পাড়া আর বাচ্চা দেওয়ার কাজটাও সারে সুন্দরবনে।
ফারাক্কা বাঁধের কারণে কমে গেছে স্বাদু পানির প্রবাহ, ফলে ঢুকে পড়ছে লবণাক্ত পানি। লবণাক্ততা বৃদ্ধিসহ আরও কিছু কারণে আগামরা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বনের প্রধান বৃক্ষ সুন্দরী। রোগ প্রতিরোধের জন্য যেসব গাছের ৫০ শতাংশ ডালপালাই এ রোগে আক্রান্ত, সেগুলো কেটে ফেলার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এতে একদিকে যেমন বনের পরিবেশের উন্নতি হবে, তেমনি নতুন গাছ গজানোর সুযোগ পাবে। সিডর-পরবর্তী সময়ে সব ধরনের গাছপালা আহরণ নিষিদ্ধ করায় বেকার হয়ে পড়েছে বাওয়ালিরা। দুবলার চরসহ আটটি জেলে বসতির স্বাদু পানির পুকুরগুলো সিডরের সময় লবণাক্ত পানিতে ভরে গিয়ে হয়ে পড়েছে পানের অযোগ্য। ফলে মানুষের পাশাপাশি বন্য প্রাণীরাও পড়ছে খাওয়ার পানির সংকটে। সুন্দরবনকে বাঁচাতে হলে এসব সমস্যার সমাধান করতে হবে। বাওয়ালিদের সীমিত আকারে গাছ কাটার অনুমতি দিতে হবে নতুবা বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি সুন্দরবনকে আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আরও মনোযোগী হতে হবে। তাহলেই বেঁচে থাকবে সুন্দরবন।

0 comments:

Post a Comment