মৌলভীবাজারের অভয়ারণ্যে হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য
সমকাল। ২২ মে ২০০৮
ম হাসানাত কামাল, মৌলভীবাজার
দেশের অন্যতম পাহাড়ি অঞ্চল মৌলভীবাজারের অর্ধেকেরও বেশি এলাকা জুড়ে বন আর ঝোপ-জঙ্গলে আবৃত। রয়েছে হাকালুকি, হাইল, কাউয়াদীঘি হাওরসহ ছোট-বড় নানা হাওর ও বিল, ডোবা, নদীনালা। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বন, হাওর ও বিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। পশুপাখির জন্য গড়েছে নিরাপদ আশ্রয়। কিন্তু মানবসৃষ্ট নানা সমস্যায় জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। বন উজাড়, পশুপাখির খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত উদ্ভিদ ধ্বংস, বন দিয়ে প্রবাহিত ছড়াগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ায় বনের পশুপাখিদের চরম খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে খাবারের সন্ধানে বন থেকে মেছোবাঘ, হরিণ, বনমোরগ, বানর, সাপ লোকালয়ে বেরিয়ে আসছে। মানুষের হাতে ধরা পড়ছে অনেক। আর রাস্তা পারাপারের সময় গাড়ির চাপায় পিস্ট হয়ে মারা যাচ্ছে অনেক প্রাণী। এদিকে দেশের অন্যতম রেইন ফরেষ্ট লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বনাঞ্চল এক সময় উদ্ভিদ ও পশুপাখির জন্য অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু মার্কিন তেল-গ্যাস কোম্পানি শেভরনের ভূতাত্ত্বিক জরিপ ও গাছচোরদের গাছ উজাড়ের কারণে লাউয়াছড়ার বনাঞ্চল বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে। বন থেকে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে আসা পশুপাখিগুলো বিপন্ন হয়ে পড়ছে। ভূতাত্ত্বিক জরিপের বিস্ফোরণে মাইক্রো-ব্যাকটেরিয়া ও অণুজীব ধ্বংস হয়েছে আর বাকিরা হুমকির মুখে। ফুডচেইন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৯৯৭ সালের জুন মাসে মাগুরছড়া বিস্ফোরণের ঘটনায় লাউয়াছড়া, কালাছড়া ও মাগুরছড়াসহ আশপাশের বনাঞ্চলের প্রাণীকূল মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বন বিভাগ, বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ, প্রাণীবিদ ও পরিবেশবিদরা সমকালের সঙ্গে আলাপকালে এ তথ্যগুলো জানান।
এদিকে প্রাণী সংরক্ষণবিদ সীতেশ রঞ্জন দেবনাথ জানান, লাউয়াছড়ার বনজুড়ে শেভরন লাল, নীল তার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখেছে। নানা রঙ-বৈচিত্র্যের পোশাক পরে বনে কর্মীরা কাজ করছে। আশপাশে নিরাপদ আশ্রয় না থাকায় এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে একরাতে বন্যপ্রাণীগুলো লাউয়াছড়া বন ছেড়ে পালিয়ে গেছে। এদের মধ্যে হয়তো বেশকিছু মারা পড়ছে। আর কিছু আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে।
সম্প্রতি লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বনাঞ্চল, জুড়ী, বড়লেখা, কুলাউড়া, কমলগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, রাজনগর ও সদরের বিভিন্ন স্থান থেকে মেছোবাঘ, হরিণ ও বিভিন্ন প্রজাতির সাপ বেরিয়ে এসে ধরা পড়ছে।
জানা গেছে, গত ৭ মে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভেতর শেভরনের বিস্ফোরিত স্থানে আতঙ্কিত হয়ে পালাতে গিয়ে বিদ্যুতের ৩৩ কেভি লাইনে পড়ে একটি বিরল প্রজাতির চশমাপড়া হনুমান মারা যায়। সম্প্রতি মৌলভীবাজার শহরতলির নিদিরমহল গ্রামের মোঃ জিলাদ মিয়ার বাড়ি থেকে প্রায় ৩ ফুট লম্বা একটি মেছোবাঘ আটক করা হয়েছে। পরে বাঘটি অবমুক্ত করা হয়। বড়লেখা উপজেলায় জনতার হাতে ১ টি মেছোবাঘকে আটক করা হলে পরে বন বিভাগ উদ্ধার করে মাধবকুণ্ড পার্কে অবমুক্ত করে দেয়। ১১ মে শ্রীমঙ্গল উপজেলার রুস্তমপুর গ্রামে রোববার কৃষকদের হাতে একটি মেছোবাঘ ধরা পড়ে। এরপর বাঘটিকে নিয়ে আসা হয় শ্রীমঙ্গলের প্রাণী সংরক্ষণবিদ ও পরিবেশবিদ সীতেশ রঞ্জন দেবের মিনি চিড়িয়াখানায়।
জুড়ী উপজেলার গোয়ালবাড়ী ইউনিয়নের পূর্বশিলুয়া গ্রামে গত ১৭ জানুয়ারি লোকজন একটি হরিণ শিকার করে মাংস ভাগ-বাটোয়ারা করার সময় পুলিশ, বিডিআর এবং বন বিভাগের লোকজন তা উদ্ধার করে মাটিতে পুঁতে ফেলে। জুড়ী উপজেলার জায়ফরনগর ইউনিয়নের দক্ষিণ ভবানীপুর গ্রামে লোকজনের হাতে একটি হরিণ ধরা পড়ে। বন বিভাগের হস্তক্ষেপে হরিণটিকে মাংসলোভীদের কবল থেকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। এদিকে গত মার্চ মাসে শ্রীমঙ্গলের কালাছড়ায় একটি উল্লুককে পিঠিয়ে মারা হয় বলে জানা গেছে। বন বিভাগ, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণবিদ সীতেশ রঞ্জন দেবনাথ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ বছরে কমপক্ষে ২০০ বন্যপ্রাণী ধরা পড়েছে। এর মধ্যে মেছোবাঘ ১০০টি, লজ্জাবতী বানর ১০টি, বানর ১০টি, অজগর ৭/৮টি, মায়া হরিণ ৭টি, খাটাশ ৭টি, গন্ধগোকুল ৩টি, গুঁইসাপ ৪টি। এগুলোকে উদ্ধর করে পরবর্তীতে সেবা দিয়ে লাউয়াছড়া বনে ছাড়া হয়েছে। এছাড়াও কমপক্ষে ৫০০টি বন মোরগ ধরা পড়েছে। জানা গেছে, মাগুরছড়া গ্যাস বিস্ফোরণের কারণে লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বিভিন্ন ছড়ার পানি শুকিয়ে যায়। টিলার মাটি ধসে ছড়াগুলো ভরাট হয়ে যায়। ফলে ছড়ায় বসবাসকারী কাঁকড়া, চিংড়ি, গিরগিট, গুঁইসাপ, কেঁচো, শামুক, টাকি মাছ ইত্যাদি মারা যায়। এসব জলজ প্রাণী মেছোবাঘসহ অন্যান্য প্রাণীর খাদ্য। অন্যদিকে বনের ভেতর ডুমুর, বেলম, পিঁপড়, বন তেঁতুল প্রভৃতি উদ্ভিদ বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় বনের খাদ্য সংকট প্রবল হয়ে পড়েছে।
বন বিভাগ ও নিসর্গ সূত্রে জানা গেছে, ১ হাজার ২৫০ হেক্টর জায়গার ওপর ১৯৯৬ সালে স্থাপিত হয় লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। এর মধ্যে নিসর্গ প্রকল্পের অধীনে লাউয়াছড়ায় ৩ হাজার একর জায়গা রয়েছে। এতে রয়েছে, ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ২৪৬ প্রজাতির পাখি। বন্যপ্রাণীর মধ্যে রয়েছে- শতাধিক প্রজাতির মাকড়সা, বিরল প্রজাতির পাখি, চশমা পরা বানর, নানা প্রজাতির বানর, বন মোরগ, কাঁকড়া, মেছোবাঘসহ বিশ্বের বিলুপ্ত প্রায় প্রাণী উল্লুক, মুখপোড়া হনুমান, মায়া হরিণ, লজ্জাবতী বানর, সাদা বাঘ, খাটোলেজি বানর, হনুমান, কাঠবিড়ালি, সাপ, প্রজাপতি, বিভিন্ন কীটপতঙ্গ ও পোকামাকড়, বন্য শহৃকর, গিরগিটি, মার্টেন, গন্ধগোকুল প্রভৃতি। প্রধান উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে চাপালিশ, সিভিট, ডুমুর, জাম, সেগুন, তেলসুর, বাটনা, আওয়াল, কনক, বনাক, রাতা, লোহাকাঠ, জারুল, আমলকি, উদল, রক্তন, লটকন, গামার, বাঁশ ইত্যাদি। এদিকে পরিবেশবিদ ও গবেষকরা বলেছেন, এখানে ৪০০ প্রজাতির পশুপাখি ছিল। কিন্তু শেভরনের ভূতাত্ত্বিক জরিপের কারণে এগুলো ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।
সম্প্রতি লাউয়াছড়া বনে আসা মার্কিন বন্যপ্রাণী গবেষক ড. এলিয়ট হাইমফ জানান, পৃথিবীর ৭টি বনে হাতেগোনা কিছু উল্লুক আছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের লাউয়াছড়া বনে ১৪টি পরিবারে বিভক্ত হয়ে ৫৭টি উল্লুক বিচরণ করে। দিনদিন বন উজাড় হয়ে যাওয়ায় এবং মানুষের তাড়া খেয়ে উল্লুকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। যা পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি।
শ্রীমঙ্গলের প্রাণী সংরক্ষণবিদ ও পরিবেশবিদ সীতেশ রঞ্জন দেব বলেন, ‘মেছোবাঘ প্রাণভয়ে পালাতে কিংবা খাদ্য অন্বেষণে লোকালয়ে আসতে ট্রাকের নিচে পৃষ্ট হয়ে মারা যায়। এর চেয়ে যন্ত্রণা আর কিছু হতে পারে না।’ তিনি আরো বলেন, ‘গাছ উজাড় ও খাদ্য সংকটের কারণে বন্যপ্রাণীগুলো বিপন্ন হয়ে পড়েছে।’
এদিকে পরিবেশ অধিদফতর সিলেট কার্যালয়ের উপ-বিভাগীয় পরিচালক মোহাম্মদ শিবলী জানান, হাকালুকি হাওরে রয়েছে পৃথিবীর বিরল প্রজাতির মাখনাসহ নানা প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ ও বন্যপ্রাণী। হাকালুকি ও হাইল হাওরসহ জেলার বিভিন্ন বিল, ডোবা ও পাহাড়ি লেকে প্রতিবছর অসংখ্য পরিযায়ী পাখি আসে। হাকালুকিতে রয়েছে নানা জাতের মাছ। এছাড়া আমাদের অরণ্যে রয়েছে নাম জানা অজানা অসংখ্য প্রাণী ও উদ্ভিদ। সবাই মিলে এগুলোকে এ জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে হবে।
0 comments:
Post a Comment