March 1, 2008

নারিকেল জিঞ্জিরা - পর্ব ১

"টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া" লাইনটি আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং প্রসংগত প্রায় সকল কাজের সাথেই কোন না কোন ভাবে জরিত৷ মূল কারন হিসেবে আমরা বিনা বাধায় বলে ফেলি দেশের সর্ব দনি এবং সর্ব উত্তর প্রান্তের নাম, নানা উপমায়, কথার কথায়৷ কিন্তু টেকনাফ মোটেও আমাদের দেশের শেষ প্রান্ত নয়৷ পৃথিবীর সর্ব বৃহত্‍ ব-দ্বীপের শেষ প্রান্তের নাম 'নারিকেল জিনজিরা' ৷ আজ থেকে প্রায় দেড় শ বছর আগে শুরু হয় বসতি বঙ্গোপসাগরের বুকে ফুলে থাকা ছোট্ট প্রবাল দ্বীপে৷ দ্বীপে শুধু নারিকেল বাগান আর নারিকেল বাগান৷ সে হিসেবেই বোধ হয় নারিকেল জিনজিরা নাম৷ মোটেও অমুলক নয়৷ বরং নাম হিসেবে এটাই বেশি স্বার্থক৷ বাংলা নামটা সবার জানা না থাকলেও সেন্ট মার্টিন নামটা আমরা প্রায় সবাই জানি৷ মুলত ব্রিট্রিশ প্রোভিনশিয়াল সার্ভেয়ারের দেয়া নামানুসারে এর নাম হয় 'সেইন্ট মার্টিন'স আইলেন্ড "৷ দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ৷ একমাত্র প্রাকৃতিক শহর৷

প্রাকৃতিক ভাবে ২০ডিগ্রি ৩৪মিনিট থেকে ২০ ডিগ্রি ৩৯মিনিট উত্তর এবং ৯২ ডিগ্রি ১৮মিনিট থেকে ৯২ ডিগ্রি ২১মিনিট পূর্বে অবস্থিত৷ দ্বীপটি মূলভূমি থেকে ৯ কিমি চওড়া চেনেল দ্বারা আলাদা হয়ে বঙ্গোপসাগরের উত্তর পূর্বে অবস্থিত৷ সাগর বক্ষে থাকলেও এর জলবায়ু নিয়ন্তিত হয় উষ্ণমন্ডলীয় মৌসুমি বায়ু দ্বারা৷ সারা বছরের গড় তাপমাত্রা প্রায় একই রকম থাকে৷ কিন্তু বর্ষা এবং এর সমসাময়িক সময়ে প্রচুর বৃষ্টিপাত জনিত কারনে দনি পূর্বাঞ্চল তলিয়ে যায়৷ মূলত দনি-পশ্চিমা মৌসুমি বৃষ্টিপাত জুন থেকে জুলাই পর্যন্ত চলে ৷ এ সময় তাপমাত্রা থাকে সবচেয়ে বেশি ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস৷ এছাড়া মোটামুটি বছরের অন্যান্য সময় স্বাভাবিকই বলা যায়৷

এতো গেলো নারিকেল জিনজিরার কিছুটা খতিয়ান৷ কিন্তু সর্ব দক্ষিনের এই প্রবাল গ্রহটি আমাদের যে কোন বয়সী প্রকৃতি প্রেমির ভাল লাগার স্থান৷ বৃহত্তর চট্টগ্রামের কঙ্বাজার জেলার শেষ অংশ এই নারিকেল জিনজিরা ৷ একপেশে নগর কেন্দ্রিক জীবনে অতিষ্ট হয়ে পালাবার উত্‍কৃষ্ট স্থান এই দ্বীপ ৷ ঢাকা থেকে সরাসরি কঙ্বাজার কিংবা চট্টগ্রাম থেকেও যাওয়া যায় টেকনাফে৷ নাফ নদীর কোলে ছোট্ট এক শহরের নাম টেকনাফ ৷ বানিজ্যিক ভাবে এই স্থান আন্তর্জাতিক বন্দর হতে পারে পাশ্ববতীদেশ মায়ানমারের নিকটবর্তী বলে। লম্বা যাত্রায় কান্ত হয়ে নাফ নদীর সৌন্দর্য প্রথমটা কিছুটা হোচট খাওয়ার মত৷ ইদানিং কালে সী ট্র্যাক নামক যন্ত্র দানবের নোঙ্গর ফেলার স্থান মূল শহরের কিছুটা বাইরের হওয়াতে অনেকই টেকনাফ শহরেই আর প্রবেশ করে না৷ দেশি নৌকায় যাত্রা তাত্তিক ভাবে নিরাপদ বলে মনে করেন না অনেকেই৷ কিন্তু শত বছরের ব্যবহৃত জেলে নৌকা আজও নিরাপদ বিনা কথায়, শুধু এতটুকু খেয়াল রাখতে হবে তা যেন এমভি সালাউদ্দিনের মত গুদাম না বানান হয়! নৌকায় নাফ নদীর সবুজে পানি যে কারও ভাললাগতে বাধ্য৷ এখানে বলে রাখা ভাল টেকনাফ থেকে নারিকেল জিনজিরার পথটার অনেকটাই কাটে এই নাফ নদীতে৷ একটু ল করলেই দেখা যাবে বাম পাশেই রয়েছে মগের মুল্লুক৷ রূপকথার কামরূপ কামাক্ষা, সর্পবিদ্যা আর জাদুটোনার দেশ বার্মা৷ যদিও এর বর্তমান নাম মায়ানমার৷ একই ধরনের নৌকা আর পোশাক আশাক বুঝতেই দিবে না ওরা এদেশিয় নয়৷ নৌকার মৃদু দুলনিকে আরও খানিকটা আনন্দময় করতে হলে চুপকরে শুয়ে যেতে হবে পাটাতনে ৷ চোখ মেললেই শুধু আকাশ, তখন ভয়ও হারিয়ে যাবে বিশাল আকাশের কাছে৷ এত বড় আকাশ একসাথে দেখার আর কোন উপায় আছে বলে আমার জানা নেই৷ মাঝে মাঝে দেখা যাবে এলবাট্্রস৷ সারেং এর ঠিক মাথার উপর নির্ভয়ে উড়ে চলছে৷ কখনও বা একা আবার কখনওবা এক ঝাক৷ আকাশ রেখে পাখির দিকে মন দিলে হামেশাই সময়টা চলে যাবে বুঝে ওঠার আগেই৷ পাখিগুলো উপরে উঠে কিছুন উড়ার পর ঝপ করে পানিতে দিবে লাফ৷ আবার ভুস করে ভেসে দেবে উড়াল৷ আজব খেলা৷ শিকার আর শিকারীর অংশ গ্রহন৷ এরই মাঝে মনে হবে দুলনি বোধ হয় বাড়িয়ে দিয়েছে কেউ খানিকটা৷ আসলে তখন সারেং তার তরী নিয়ে দরিয়ায়৷ ঢেউ একটু বেশি হলেই কেউ কেউ বলে উঠবে " দইজ্যা গরম, দইজ্যা গরম "৷ যদিও এ অঞ্চলের আধুনিক Oceanographic অবস্থা জানা যায় খুব কম তবুও দেখা যায় সমুদ্রপৃষ্ঠে স্রোতের মূল কারন হলো বাতাস৷ বছরের নভেম্বর-মার্চ অবধি উত্তর-পূর্ব হতে জোড়াল বায়ু প্রবাহিত হয় যা মূলত সাইকোন প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে৷ নারিকেল জিনজিরায় প্রতি দিনে দুবার জোয়ার, দুবার ভাটা আসে৷ শাহপুরি দ্বীপে সমুদ্র স্রোতের গড় উচ্চতা (mean tidal level, ML) ১.৮৭৪ মিটার প্রায়৷ আর সর্বচ্চো Astronomical tide (HAT) রেকর্ড করা হয় ৪.১ মিটার (BIWTA,1996) ৷ যা ভীতিকর কিছুই না৷ তাই " নাই মরতেই ভুত" হওয়ার মানসিকতা ত্যাগ করলে দেশী নৌকার যাত্রা হবে অনেক বেশী রোমাঞ্চকর আর আলাদ স্বাধের৷ দেখতে দেখতে সময় যাবে শেষ হয়ে৷ এক সময় খেয়াল করলেই দেখা যাবে তলদেশ৷ একটু সামনেই স্বপ্নিল " নারিকেল জিনজিরা"৷ আমরা অনেকেই বোধ হয় হলিউডের টাইটানিক খ্যাত অভিনেতা লিওনার্ড ডিকাপ্রিয় অভিনিত “the beach” মুভিটা দেখেছি৷ সামাজিক যাতনা এড়ানর জন্য দূরে কোন একদ্বীপে আশ্রয় খোজে সভ্যরা৷ দূর থেকে আমার কাছে মনে হল এটাই সে স্থান যা দিবে কান্তিহীন আনন্দ আর নির্ভেজাল বায়ু৷ যান্ত্রিকতা এড়ানর জন্য এর চেয়ে আদর্শ আর কিই বা আছে৷ এবার নামর পালা৷ ভাঙ্গা এক জেটিতে ভিড়ল আমাদের নৌকা, এম ভি ফারুক৷ শুরু হলো দ্বীপবাস যাপন৷

দল হিসেবে আমরা বেশ ভারি৷ পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা ৩ টি দলে ভাগ হয়ে গেলাম৷ নিছক ভ্রমন ছিলনা আমাদের উদ্দেশ্য৷ আগামী বছর মূলভু খন্ড টেকনাফের শাহপুরি থেকে সাতার করবে আমাদেরই অনেকে৷ মূলত এটা হবে একটা লম্বা স্নর্কলিং, প্রায় ১১ কিমি৷ তাই আমাদের এই বিশাল দল৷ মূল পরিকল্পনাকারী দলে প্রখ্যাত স্কুবা ডাইভার হামিদ ভাইয়ের সাথে ছিলেন পাখি বিশ্লেষক ইনাম ভাই এবং ফারুখ ভাই৷ তাদের বিশাল পরিকল্পনার মালামাল সামলানর দ্বায়িত্বে ছিলেন মনা৷ দলে ছিলাম আমরা সবচেয়ে বড়৷ ১২ জন৷ নানা বয়সি৷ এ দলের পরিকল্পনা করেন আজিমপুরস্থ "আমাদের পাঠ চক্র" এর দিপু ভাই৷ এর আগে ঢাকা ছেড়ে যাওয়া দলে ছিলেন সেলিম, জাহাঙ্গির আর রবিন ভাই৷ তারা মূলত টেকনাফ এবং শাহপুরি দ্বীপের জরিপ কাজ সম্পন্ন করেন৷ ছেলে বুড়ো সবাই মিলে জমা হলাম আতিক ভাইয়ের Oceanic Scuba Diving Service এ৷ তাবু ফেলা হল৷ প্রথম দিন সবাই একটু কান্তু৷ তাবু খাটার পর শুরু হল রান্নার প্রস্তুতি৷ বাজার সদাই আর কি শুধু মাছ, তাও সামুদ্রীক৷ আমাদের অনেকেরই খাওয়ার অভ্যেস নেই৷ মাছ ধরাই দ্বীপবাসিদের প্রধান জীবিকা৷ মূলত মোট জনগোষ্ঠির ৮০ ভাগ মাছ ধরা এবং এর সাথে কোন না কোন ভাবে জরিত৷ ১৯৯৬ এর এক জরিপে দেখা যায় মোট ১৫৯টি নৌকার মধ্যে জেলে নৌকাই ছিল প্রায় ১৫৩টি৷ বর্তমান পরিস্তিতি কিছুটা অন্যরকম৷ পর্যটন এর জন্য দায়ী৷ আনুপাতিক ভাবে জেলে নৌকা বাড়লেও টুরিষ্ট নৌকা বেড়েছে আরও বেশি৷ এধরনের নৌকার ব্যবহার বছরের অক্টোবরের শেষ থেকে ফেব্রুয়ারীর শেষ পর্যন্ত প্রায়৷ ছেড়া দ্বীপ এবং আশপাশের এলাকায় ভ্রমনই হলো এদের আয়ের প্রধান উত্‍স৷ জেলে দিনের দুই সময়ে মাছ ধরতে যায়৷ এক দল বেশ ভোরে আর আরেক দল বেলা তিনটার দিকে৷ ৬-৭ ঘন্টা চলে মাছ শিকার৷ কিন্তু মাছের পরিমান যাচ্ছে কমে৷ মাছ ব্যবসায়ি জব্বার সাহেবের সাথে কথা বলায় জানা গেল আগে যেখানে মাত্র এক দেড় ঘন্টা নৌকা চালিয়ে যে মাছ পাওয়া যেত এখন তা আর পাওয়া যায় না৷ শুধু যেতেই এখন সময় নেয় ৩-৪ ঘন্টা৷ তারপরও মাছের পরিমান কম৷ এতে করে বাজার দর যাচেছ বেড়ে৷ এই বারেই দেখা গেল মাছ আসছে কঙ্বাজার থেকে৷ হোটেল ব্যবসায়ীরা মাছের চাহিদা মেটানর জন্য বাধ্য হয়ে কিনে আনছেন মাছ৷ নারিকেল জিনজিরা এবং এর আশপাশে আগে প্রচুর লব স্টার এবং চিংড়ি পাওয়া যেত৷ কিন্তু এদের দেখা পাওয়া এখন ভার৷ কারন এরা বাস করে পাথুরে এলাকায়৷ কিন্তু দ্বীপের আশেপাশে বেশখানিকটা এলাকায় এখন প্রবাল পাওয়া ভারি কঠিন৷ সব বিক্রি হয়ে গেছে৷ হাজার বছর ধরে ধীরে ধীরে যে প্রবাল তৈরী করে ছিল সাগর তা দিয়ে তৈরী হল দালান৷ বরই নির্মম৷ মাছ না পাওয়ার অন্যতম প্রধান কারন তাদের বাসস্থানের অভাব৷ তবুও ভাল সচেতনেতা এসেছে এখন৷ তাও বেশ দেরিতে৷ এখন আর দেখা যায়না কোন জেলে ছেনি বাটাল নিয়ে নামছে পানিতে৷ কিছুটা এখনও আছে৷ তাও আশা করি শেষ হয়ে যাবে৷ কাশেম মাষ্টার সাহেবের সাথে কথা বলার সময় তার আপে শোনা গেল৷ আমি বেশ ক দিন তাকে মাঝ বেলায় জেটির কাছে দাড়িয়ে থাকতে দেখেছি৷ এত মানুষ যে এ দ্বীপে আসবে তা তিনি ঠিক বুঝে উঠতে পারেননা৷ প্রথম বাঙ্গালীর মুখে শোনা যায় অনেক কথা৷ মাত্র ক টা ছাপড়া ছিল, ক একটা মানুষ৷ " সেই সেন মার্টিনে আজ এত মানুষ " আমি বুজিনা তারা কি দেখে, সব তো প্রায় শেষ৷

0 comments:

Post a Comment