March 1, 2008

নারিকেল জিঞ্জিরা - পর্ব ২

মুনতাসির মামুন ইমরান

পরদিন সকালে বেরুলাম জরীপ কাজে৷ মূল উদ্দেশ্য শাহপুরি থেকে শুরু হলে আমাদের সাতার সেন্ট মার্টিনের কোথায় শেষ হবে তা ঠিক করা৷ বেশ কঠিন কাজ৷ স্রোত দেখা, গভীরতা মাপা, এটা সেটা কত কি৷ সারা বেলা গেল এই করতেই৷ বিকালে গ্রিল ফিসের সাথে ক্যাম্প ফায়ার৷ আতিক ভাইয়ের ওসিয়ানিক স্কুবা ডাইভিং স্কুলের উঠান তখন ভরপুর৷ এনজেল ডাস্ট এর সাজ্জাদ ভাই, ইকো টুরস্ এর রাকা ভাই, কাশেম মাষ্টার সাহেব, মেম্বার সাহেবেরা আরও কত জন৷ বিশাল এক আয়োজন৷ রান্নার আয়োজক ফারুখ ভাই৷ দৈনিক জনকন্ঠের মাধ্যমে অনেকেই তার রেসিপি পেয়েছেন হয়তো বা৷ রাত ১০টা পর্যন্ত চলল আনন্দ ঘন্টা৷

পরদিন সকালে আতিক ভাইয়ের সাথে সবাই নামলাম সাগরে৷ বিশাল সাগরের উত্তাল জলরাশি কিছুটা কান্ত এই শীতে তাতে কি বাকিটা যা আছে তাও কম কিসে৷ চলল দাপাদাপি৷ সবাই একসাথে৷ বিশাল আকার ধারন করল যখন ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা যোগ দিল মিছিলে৷ মহাসমুদ্রের পারে জলত্‍সব৷ এর মাঝে যোগ হল হামিদ ভাইয়ের র্যাফ্ট বোটে মেয়েদের আনন্দ ভ্রমন৷ কেউ সাঁতরে কেউ নৌকায় কেউবা লাইফ জ্যকেটের ভরসায়৷ এর মাঝে ফারক ভাই নামলেন গ্যাস ডাইভিং এ৷ যথেষ্ট আনন্দ উপভোগ করে আমরা গেলাম আসল কাজে৷ পার ধরে বোটে নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকলাম ছেড়া দ্বীপের দিকে৷ আমি হামিদ ভাই Sonrkeling করে আর বোটে রিমন, জাহাঙ্গির আর সেলিম ভাই৷ সাগরে সাতার কাটছি৷ একটু অন্যরকম৷ প্রথম দিনে হিসেবে ভাই হলো৷ প্রায় ৪ কিলোমিটার৷ দুপুর হয়ে গেছে৷ ফেরার পালা এবার৷ সমস্যা দেখা দিল তখনই৷ এতোনতো আশা হয়েছে স্রোতের দিকে আর এবার বিপরিতে৷ বোটে তখন ৪ জন৷ একজনকে আগেই নামিয়ে দেয়া হয়েছে৷ তাও কিছুটা যাওয়ার পরই হামিদ ভাই আর সেলিম ভাই নেমে গেলেন৷ প্রায় ১ ঘন্টা অনন্ত চেষ্টা করার পর কিছুটা এগুতে পারলাম৷ এর পর ডাইভ ট্যাঙ্ক কাধে নিয়ে নেমে এলাম৷ মাথার উপর রোদ আর পায়ের নিচে আগুনে গরম বালি৷ অস্থির অবস্থা৷ যখন পৌছলাম আমাদের বেইজ ক্যাম্পে তখন শরীরে শক্তির শেষ রিন্দুটা বাকি বোধ হয়৷ গিয়ার গুলো থেকে লবণ পানি পরিস্কার করে শুকাতে দেয়ার পর নিজের গোসল সেরে খাওয়া দাওয়া৷ তাও ভাল ফারুখ ভাই ছিলেন৷ তাই আলিশান খাওয়া হচ্ছিল বেশ৷ বিকালটা তো কখন গেল বুঝতেই পারলাম না৷ সূর্যাস্থ দেখলাম৷ রাত হলে শুধুই আড্ডা আর আড্ডা৷ পরদিনের পরিকল্পনা করা হলো রাতের খাওয়ার পর৷

সকালের নাস্তা সেরে দল মিলে বেরুলাম৷ আজ সরাসরি চলে গেলাম ছেড়া দ্বীপে, হেটে৷ পথের মাঝেই আমরা না না ধরনের কোরাল দেখতে পেলাম৷ যদিও কোনটাই আর বেচে নেই৷ পানিতে নেমে গেলাম৷ নানা ধরনের নানা বর্ণের কোরাল দেখতে পেলাম, দেখলাম মাছ৷ আমার বাসার একুরিয়ামটা আমার প্রথম দিকে খুব ভাল লাগত৷ কিন্তু এখন আর তেমন না৷ কারন একুরিয়াম খুবই সীমাবন্ধ এক জলাধার৷ কিন্তু এখন আমি যেখানে তা আমার বাসার একুরিয়ামের চেয়ে তো কম নয়ই বরং বিশাল৷ এত মাছ আর কত যে রং৷ অবাক হতে হয় বিশ্ময়কর এই জগত দেখার সৌভাগ্য হয়তো অনেকেরই হয়নি৷ নারিকেল জিনজিরার সৌন্দর্য্য অবাক করা, কোন সন্দেহ নাই৷ কিন্তু এর পানির নিচের অবসথা আরও রোমঞ্চকর৷ আরও সুন্দর৷ সেন্ট মার্টিন কে কেন কোরাল দ্বীপ বলা হয় তা এবার বুঝতে পারলাম৷ হরেক রকমের কোরাল তার প্রকৃষ্ট উদাহরন৷ এখন প্রশ্ন আসতে পারে সেন্ট মার্টিন কে কেন কোরাল আইলেন্ড বলা হয়৷ মুলত এখানে শক্ত এবং কেরালাইন লাইমষ্টোন দেখাতে পাওয়া যায়৷ এগুলোই কোরার কাস্টার হিসেবে পরিবর্তিত হয়ে যায় পরবর্তীকালে। আর সেন্ট মার্টিন এ প্রচুর পরিমানে কোরালের উপস্তিতিই এ দ্বীপকে 'কোরাল দ্বীপ' বলতে বাধ্য করে, যদিও প্রথম দিকে এর কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ছিল না৷ কিন্তু ১৯৮৫ সালে নারিকেল জিনজিরা কে জাতীয় মেরিন পার্ক হিসেবে প্রস্তাব করা হয় কোরাল রিফের উপস্থিতির কারনে৷ (খান, ১৯৮৫; আনোয়ার,১৯৮৮)

কোরাল রীফ বলতে আমরা হামেশাই বুঝে ফেলি রং বেরং এর পাথরের আশে পাশে সুন্দর সুন্দর মাছ আর ক্রিস্টাল কিয়ার পানি৷ উপর থেকে তাকালে যেন তলদেশ দেখা যায় (!)৷ ভ্রান্ত ধারনা ছাড়া এটা কিছুই না৷ আসলে কোরাল রীফে সৃষ্টির মূলে রয়েছে নানাবিধ জটিল প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া৷ Boitic এবং Abiotic এর ক্রিয়ার মাধ্যমে Calcification, Cementation, Consolidation, Wind, Sea level fluctuation, Current ইত্যাদির নানা ধাপ অতিক্রম করে তৈরি হয় বিভিন্ন আকারের রীফ৷ স্যার চালর্স ডারউন কোরাল রীফ কে তিন ভাগে ভাগ করেছেন, fringing reefs, barrier reefs, Atolls ।

ডারউনের ধারনা অনুযায়ী fringing reefs গুলো সবচেয়ে কম সময়ে তৈরী হয় এবং মূল ভূ খন্ড বা উচু জমির সাথে কোন না কোন ভাবে যুক্ত থাকে৷ কিন্তু অন্যদিকে barrier reefs, Atolls গুলো কিছুটা বেশি সময় নিয়ে তৈরি হয়ে থাকে৷ fringing reefs ধরনের রীফ গুলোকেই উষ্ণ মন্ডলীয় সাগর এবং উপসাগরে বেশি দেখতে পাওয়া যায়৷ সাধারন পর্যটকদের আর্কষন হয়ে দাড়ায় এরাই৷ স্কুবা ডাইভারদের আনন্দের মূল উপাদান হিসেবে পরিচিতি লাভ করে খুব দ্রুত৷ নারিকেল জিনজিরার আশে পাশে অল্প গভীর জলে এধরনের কোরাল দেখা যায় প্রচুর৷ দ্বীপের উত্তর পশ্চিমে এবং দনি পূর্বে বেশ কিছু লেগুন দেখা গেলেও তারা বেরিয়ার রীফের মত মোটেও গভীর নয়৷ এধরনের লেগুন বা খাড়িতে পাওয়া যায় প্রচুর মাছ৷ নদী মাতৃক এদেশে বিদেশী অনেক খেলা প্রচলিত থাকলেও জল কেন্দ্রিক কোন জনপ্রিয় খেলা আছে কিনা আমার জানা নেই৷ থাকলেও ঐ একটাই, নৌকা বাইচ৷ কিন্তু প্রচুর লোকবল দরকার সেখানেও৷ সে হিসেবে water ski, bording, snorkeling, scuba diving ইত্যাদি হতে পারে নারিকেল জিনজিরার অন্যতম আকর্ষনীয় বিনোদন মাধ্যম৷ এধরনের স্পোর্টসের জন্য খুব বেশি পয়সাকড়ি কিংবা লোক বলের প্রয়োজন হয় না৷ তাও ভাল এবারে দেখে এলাম আতিক ভাইয়ের সাহসী উদ্দোগ৷ ব্যবসায়ীক চিন্তা ধারায় তৈরী হলেও প্রসংশার দাবীদার এক বাক্যে৷ পানির নিচের আলাদা জগত্‍টা আমাদের কাছে হয়তো কোন দিনও পরিচিত হত না, ওশিয়ানিক স্কুবা ডাইভিং সার্ভিস এর কল্যানে তাও এখন কিছুটা সম্বব৷

অর্থকরী খরচ করে প্রবাল দ্বীপে যাওয়ার পরে প্রবাল না দেখাটা বোধ করি অন্যায়৷ বিচারে কার সৌন্দর্য বেশি তা আমি বলতে পারব না কিন্তু এটা ঠিক সাগরের নিচটা অসাধারন৷ এর জন্য নিজ থেকে দরকার শারীরীক যোগ্যতা আর সাতার জানা৷ দ্বীপের চারপাশের প্রায় সব জায়গাতেই দেখা যায় হরেক রকমের মাছ৷ আছে জলজ উদ্বিদ আর প্রবাল৷ আর এসব দেখার জন্য মাঝ দরিয়ায় ঝাপ দেয়ার কোন দরকার নাই৷ তীরবর্তী ১০ থেকে ১৫ ফুট গভীরতার মধ্যেই দেখা যাবে এত কিছু৷ এধরনের অল্প গভীর পানিতে থাকে ভাল সূর্যে আলো আর তাই পরিবেশ হয়ে ওঠে আরও দর্শনীয়৷ ভাগ্য ভাল থাকলে দেখা যাবে হাজার হাজার মাছের ঝাক৷ বিলাশ লম্বা মাছের ঝাকের মধ্যে কখন যে ঢুকে পরবেন তা বোঝাও যাবে না৷ আরও কিছুন ধর্য্য ধরলে পাওয়া যাবে বড় মাছের দেখা৷ কারন ছোট মাছ গুলোকে তারা করে নিয়ে চলে বড় মাছ৷ তাই হঠাত্‍ই হতো সামনে চলে আসবে বড় কিছু৷ ভয় পাওয়ার দরকার নাই৷ খুবই নিরিহ এরা৷

প্রবাল গুলোকে কাছ থেকে দেখতে প্রথমে অবশ্যই ভয়ঙ্কর মনে হতে পারে৷ কেমন যেন একটা পরিবেশ৷ একে তো একেবারে অপরিচিত তার উপর বিদঘুটে অবয়ব কোন কোনটার৷ কোটার রং উজ্বল সবুজ আবার কোনটা লালচে ধরনের৷ মৌমাছির চাকের মত দেখতে এক ধরনের প্রবাল৷ তাদের নামও হানিকম্ব৷ এটার নাম ব্রেন কেরাল, উপর থেকে দেখতে অবশ্যই মগজের মতই মনে হয়৷ হালকা বাদামীর মাঝে কিছুটা সবুজে অংশ এটাকে আরও খানিকটা ভয়ংকর করে তোলে৷ কিন্তু কিছুটা সময় এদের মাঝে সাতার কাটলেই বোঝা যাবে এরা কতটা নিরীহ৷ মূলত মাছের খাদ্য হিসেবে এরা ব্যবহৃত হয়৷ সমস্য হলো অন্যখানে, প্রবাল গুলোতে থাকে মারাত্নক ধার৷ একটু অসতর্ক হলেই আর রা নেই৷ দূঘর্টনা হতে বাধ্য৷ সেলিম ভাইয়ের পায়ে যে পরিমান কেটে গিয়েছিল তাদেখে আমরা বেশ ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম৷ অন্য অবস্থায় হলে আমরা অবশ্যই হাসপাতালে যেতাম৷ কিন্তু এই উন্মুক্ত প্রান্তরে কেন জানি কেউই তারাহুরো দেখালাম না৷ মনে হয় সবাই জানতাম, এখানে এটা এমনি ঠিক হয়ে যাবে৷ ডাইভ বোট থেকে নামার সময় খেয়াল না করায় তার এই অবস্থা৷ ফার্ষ্ট এইড দেয়া হলো৷ কিছুটা রা৷ আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা মতে দ্বীপের প্রায় সব জায়গায় স্কুবা বা স্নর্কলিং করা গেলেও ছেড়া দ্বীপ এবং এর আশ পাশের জায়গা গুলো প্রায় স্বর্গ ৷ উচু নিচু কেরাল আর পাথরের জন্য মাছ ধরাটা এখানে কিছুটা কম৷ উত্তর পূর্বে সবচেয়ে বেশি সুন্দর৷ এখানে স্কুবা করা যাবে প্রায় অনেক খানি জায়গায়৷ আর যদি আরও খানিকটা বহি সমুদ্রে যাওয়া যায় তবে দেখা যাবে সার্কদের৷ এটা অবশ্য আমার কথা না, বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর কয়েকজন ডাইভারের সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়াতে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম৷ হামিদ ভাইও তাই বলেন৷ হয়তোবা কোন একদিন জাতীয় কোন জনপ্রিয় দৈনিকে দেখা যাবে "Guaranteed dive with hammer head Shark" নামের বিজ্ঞাপণ৷ এটা অসম্ভব নয়, শুধু দরকার উদ্যোগ৷ আমরা সবাই যাব ঢাকা থেকে, সারা দেশ থেকে৷ অবাক করা সৌন্দর্য শহর নারিকেল জিনজিরায় আর সাগর তলের দেখা আলোর না দেখা রুপ দেখতে৷ উত্তর পাড়ার বাম পাশটায় দেখা যাবে বেশ কয়েকটা লেগুন৷ ভাটার সময় হাটু পানি৷ আর জোয়ারে বুক৷ বিদেশি বইতে পাওয়া লেগুনের শোভা দেখতে পাওয়া যাবে চোখের সামনে৷ কিছুন ধৈর্য্য আর একটু খেয়াল করলে এমনিতেই দেখা যাবে ঝাক ঝাক মাছ ৷ আর যদি কিছু বিস্কিটের গুড়ো নিয়ে যাওয়া যায় তবে তো আর কথাই নাই৷ সময় হারিয়ে যাবে সমুদ্রের কাছে৷ এখানে একটা কথা বলে রাখা উচিত, খালি পায়ে কোন অবস্থাতেই কোরাল কিংবা তীরে হাটা উচিত না৷ এতে করে পাদুকা জোড়া ভিজে নষ্ট হওয়ার ভয় থাকলেও পায়ের যত্ন আগে নেয়া উচিত, নয়তো সারা ট্রিপই ভন্ডুল৷ চলতে থাকল আমাদের অভিযান, সারা দিন, সারা বেলা, সেই সকাল থেকে বিকাল অবদি কান্তি এলেও হামিদ ভাইয়ের কাছ থেকে ছাড় পাওয়া যেত না৷ আনডার ওয়াটার ফটোগ্রাফি করার সময় তো জান যায় যায়৷ আমার ৩ মি মি পুরু ডাইভ স্যুটটায় ঠান্ডা মানত না ঘন্টা খানেক পর৷ একটার পর একটা ডুবদিয়ে ছবি তোলা৷ তাও মুভমেন্টে ভুল হলে আবার করতে হতো৷ কিছুই করার নাই, শুধু এটাই ভাবি আমি যার সাথে কাজ করছি তার অভিজ্ঞতায় National Geography এর সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা৷ এটা শুধু পাওয়া না যে কারও জন্য ভাগ্য বলা যায়, অন্তত আমার মত কারউ জন্য৷ সমস্যা হলো একদিনে এক রোল ছবির বেশি তোলা যেত না৷ ক্যামেরাটা শুকাতে হত তারপর আবার অন্য আরেকটা রোল৷ পানি থেকে ওঠার পর জেকে বসত ঠান্ডা৷ তাই নিয়েই ছেড়া দ্বীপের মৌসুমি আর সাদ্দামের দোকানে পালা করে চা আর গরম মাছ ভাজা খেতাম৷ দাম একটুও বেশি না৷ বরং মূল বাজারের যে কোন দোকানের চেয়ে বেশ খানিকটা তো কমই৷ তার উপর বাসি খাবার পাওয়ার কোন ভয় নেই৷ বাজারের হোটেল গুলো সাতদিন আগের মাছ আজকের বলে দেধারে চালিয়েদেয়৷ তবে কিছু দোকানের খাবারের কথা না বললেই নয়,উন্মুক্ত সাগরের পারে বসে Angel Dust এর খাবার কারও খারাপ লাগবে বলে মনে হয় না৷ ডেকরেশান এবং অন্যান্য সব কিছুই বেশ আলাদা৷ প্রায়ই আমরা দলবেধে কফি খেতে যেতাম৷ পরন্ত বেলা সূর্যাস্থ দেখা না গেলেও আকাশটা কে ভারি অদ্ভুত লাগত৷ এটাই বা কম কি, এত কম টাকায় এত সুন্দর আকাশ আর কোথায় কেনা যায় ?

রাতের বেলা সেলিম ভাই হঠাত্‍ করেই তাবু থেকে বের হয়ে সবাইকে ডাকাডাকি শুরু করে দিলেন৷ অনেক রাতে ঘুমাতে যাওয়ার পর আবার ডাকাডাকি কেন, যা হোক শোনা গেল, কিছুন আগে ভূমিকম্প হয়ে গেছে৷ আমি অবশ্য কিছুই বুঝিনি৷ প্রথমটা তো আমরা বিশ্বাসই করিনি৷ কিন্তু সকালে ওস্তাদ( নেভির অবসর প্রাপ্ত কমান্ড ডাইভার শাহনেয়াজ ভাই ) এর কাছেও তাই জানা গেল৷ আর এখানে ভুমিকম্প মোটেও নতুন কোন ঘটনা না৷ আসলে আমরা সবাই ভূমিকম্পের ধ্বংসের ঘটনা কমবেশি জানি৷ কিন্তু এটাবোধ হয় জানি না যে পৃথিবীর আকর্ষনীয় কোরাল রীফ গুলো গড়ে ওঠে ভূমিকম্পন প্রবণ এলাকা গুলো থেকে৷ বাংলাদেশের জন্য এটাই সত্য যে ভূমিকম্প এখানে কোরাল রীফ গড়ে তুলতে কার্যকরী ভাবে সাহায্য করেছে৷ যেমনটা দেখা যায় ইন্দোনেশিয়ায়৷ সেখানে ভূকম্পনের ফলে কোরাল রীফের কলোনি তৈরি হয়েছে অনেক৷,সেদেশের আরকিপেলাগো (Archipelago) পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভূকম্পন প্রবন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত৷ আর এখানেই গড়ে উঠেছে অতুলনীয় সব কোরাল সিসটেম৷ নারিকেল জিনজিরার ক্ষেত্রে ধরা হয় বহু বছর আগে বড় বড় পাথরের বোল্ডার গুলো একসাথে জোড়া লেগেছিল এই কোরাল দিয়ে যা দিয়ে রীফ তৈরি হয়৷ আর হয়তোবা বড় ধরনের কোন ভূকম্পের ফলে বোল্ডার গুলো সরে গেছে মূল ভূমি থেকে৷ যদিও তেমন কোন বড় ধরনের ভূমিকম্পের কথা জানা যায় না৷ তবুও বৈজ্ঞানিক ভাবে এটাই ধারনা করা হয়৷ তবে এতটুকু জানা যায় দ্বীপটির উপরিভাগের খানিকটা নিচেই আছে বড় বড় বোল্ডার, যারা নিজেরা সমান্তরাল ভাবে অবস্তিত৷ অনেকের মতে এই পাথরের গঠনই দ্বীপ তৈরির মূল উপাদান এবং এরা ভূমিকম্পনে না হলেও বড় ধরনের সাইকোনিক ঝড়ের কারনেও এরা মূলভূমি কিংবা সমুদ্রতল থেকে চাপের কারনে জেগে উঠেছে৷ তাই এর উত্‍পত্তি নিয়ে আছে মতভেদ৷ বৃদ্ধ ব্যক্তিদের কাছ থেকে জানা যায় আগে নাকি বার্মা আর এই দ্বীপ ছিল পাশাপাশি৷ নাফ নদীটাই ছিল শুধু এদের মাঝে৷ ধীরে ধীরে দ্বীপ সরে আসে, নাফ নদী চওড়া হতে থাকে৷ তার কারন তারা জানেনা৷ তবে এরসবই পৌরাণিক কাহিনীর মত৷

অনিনন্দ্য সুন্দর এই দ্বীপ আমাদের দেশের গর্ব৷ একটু পরিকল্পনা আর দায়িত্বশীল হস্তপেই বদলে দিতে পারে এর পুরো রুপ৷ বর্তমানে দ্বীপটি বেশ কিছু দিক থেকে হুমকির সামনে৷ টুরিজমের নামে ইটের বদলে প্রবালের ব্যবহার, গ্যাস, তেল, নৌকার বর্জ্য ইত্যাদি যত্রতত্র নিক্ষেপ ৷ নোঙ্গর ফেলার ফলে ভেঙ্গে যাচ্ছে তলদেশের প্রবাল গুলো৷ এত সুন্দর এই দ্বীপে কোন স্থায়ী জেটি নেই, নেই কোন ভাসমান Anchorage System, ভাবতে অবাক লাগে ! ছোট ছোট নৌকা গুলোকে তীরে তোলার সময় হয়ে যাচ্ছে অপুরনীয় ক্ষতি, প্রবাল গুলো যাচেছ ভেঙ্গে৷ তার উপরেও তো আছে প্রবাল সংগ্রহকারীদের দৌরাত্ব৷ আমরা যদি এভাবে হিসেব করি, প্রতি বছর সারা দেশ থেকে ৩০,০০০ পর্যটক যদি এ দ্বীপ থেকে মাত্র একটা করে ছোট প্রবালও নিয়ে যায় তবে অবস্থাটা কি হবে? ভাবা উচিত্‍ সবার৷ সরকারী অফিস কিংবা অন্যন্য স্থানে বাগানের আশেপাশে লেখা থাকে ' ফুল ছিড়বেন না ' ইত্যাদি ইত্যাদি, কিন্তু হায় ! এমন একটা লেখাও চোখে এলনা যে প্রবাল ধ্বংস বা সংগ্রহ থেকে দূরে থাকুন৷ অবস্থার পরিবর্তন না হলে হয়তো নিকট ভবিষতে প্রবাল দ্বীপে পা ভেজানর পানি আর ঢাকা থেকে আমদানি করা সামুদ্রিক মাছ পাওয়া গেলেও প্রবাল আর পাওয়া যাবে না৷ তখন বোধ হয় 'গুলিস্তান' সিনেমা হল বিহীন গুলিস্তানের মতোই প্রবালহীন প্রবাল দ্বীপ হবে আমাদের সেইন্ট মার্টিন্স আইলেন্ড৷।
সূত্র: http://www.nature.com.bd

0 comments:

Post a Comment