March 1, 2008

হাওরের কুড়োল

হিজল গাছের ডালে বসে আছে একটি কুড়োল। ছবি: ড. রেজা খান

ড. রেজা খা

লৌয়ারি নদীর পাড়ে শান্ত, সুনিবিড় গ্রাম গোলাবাড়ি। টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে সুনামগঞ্জ হয়ে লৌয়ারি মিশেছে সুরমা নদীতে। বাংলাদেশের আর দশটা গ্রামের মত হলেও গোলাবাড়ি সম্ববত: সবচেয়ে ছোট গ্রাম। অধিবাসি এক ডজন বা তার কাছাকাছি। পাশেই এরচে' সামান্য বড় জয়পুরা গ্রাম। এ বাদে আশেপাশে ১০ বর্গকিলোমিটারে লোকালয়ের চিহ্ন নেই।

গোলাবাড়ির দেখা টাঙ্গুয়ার হাওরে যাওয়ার পথে। ইঞ্জিন নৌকা থেকে হঠাৎই একটা লম্বা বেরুনা গাছের মাথায় বড় একটা পাখির বাসা চোখে পড়ল। মাঝিকে ইশারা করলাম। গোলাবাড়িতে নোঙর ফেলা হল।

মধ্য দুপুরে কতক মানুষ গোসলের পর গা শুকাচ্ছে। নৌকা থেকে নেমে তাদের দিকে হাঁটতে থাকি। জিজ্ঞাসা করলাম বেরুনা গাছের মগডালে ওটা কুড়োল (Kurol) (কুড়া)-এর বাসা কী না। ইংরেজীতে বলে Pallas's/Ring-tailed Fishing Eagle. একবাক্যে সবাই সায় দিল। তাদের সাথে কথা আর শেষ হলনা। তার আগেই স্ত্রী কুড়োল তার বাসা থেকে ডানা ঝাপটালো এবং পরক্ষণেই অতি পরিচিত ক্রুরর-ক্ররর-ক্রররল স্বরে ডেকে উঠল। পুরুষ সঙ্গীর প্রতি-উত্তর এল প্রায় সাথে সাথে। মূহুর্তের মধ্যেই পুরুষ কুড়োলটি উড়ে এল এবং বাসার উপর চক্কর দিতে লাগল। আর স্ত্রী কুড়োলটিও তার সঙ্গীকে অনুসরণ করে চক্কর দিয়ে আশেপাশের সব পাখিদের তাড়া করল। গোলাবাড়ি গ্রামটি উত্তর দক্ষিণে প্রসারিত। উত্তরের প্রায় দুই হেক্টর জায়গা খালি পড়ে আছে। সেখানে দেশীয় গাছগাছড়া আর ঝোপঝাড়ের জঙ্গল। বেরুনা, হিজল, করোচ আর সাইকাস জাতীয় গাছপালায় ভরা। এটা খাস জমি। স্থানীয় একটি মসজিদের নামে বরাদ্দ। গ্রামবাসীরাই মসজিদ পরিচালনা করে। পাশেই গোরস্থান। স্থানীয়রা কাঠ বা জ্বালানির প্রয়োজনেও এই জমি ব্যবহার করে না। সে কারণেই স্থানটি নানা জাতের পাখি, সরিসৃপ, পোকামাকড় আর ইঁদুরের স্বর্গরাজ্য। কুড়োল পরিবার এদেরই একজন।

কুড়োল যে গাছে বাসা বেঁধেছে তার পাশেই টাঙ্গুয়ার হাওরের একটা অংশ পড়েছে। এখানেই প্রায় তিন হাজার waterfowl দেখেছিলাম। কুড়োল অত্যন্ত দক্ষ শিকারি। হিজল বা বেরুনা গাছের উঁচু ডাল থেকে শিকারকে তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষণ করে। তারপর ছোঁ মেরে ঝাঁপিয়ে পড়ে হাওরে বিচরণকারি জলজ হাঁসের উপর। স্থানীয়দের হিসেবে কুড়োল দিনে অন্তত দুটি হাঁস শিকার করে। বয়স্ক একজন জানালেন কুড়োল এ অঞ্চলে বিচরণ করছে প্রায় এক যুগ ধরে। শীতের শুরুতে এরা বাসা বাঁধতে শুরু করে। একই বাসায় এরা দীর্ধ দিন বাস করে। ছোটখাট কাঠি, কঞ্চি, টুকরা বাঁশ ইত্যাদি দিয়ে তৈরি বাসা এরা প্রতি বছরই সংস্কার করে। এভাবে বছরের পর বছর বাসার আকৃতি বাড়তে থাকে। অনেক সময় বাসার ভারে গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়ে। তখন এরা পাশের গাছে অথবা দূরে কোথাও চলে যায়।

ছবি: ড. রেজা খান
গোলাবাড়ির বাসাটি মনে হল তিন বছরের পুরোনো। ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে বেরুনা গাছ। গাছের মাথায় প্রায় ৬ মিটার উঁচুতে এই বাসা। প্রথাগতভাবে কুড়োল দুটি ডিম দেয়। ডিম ফুটে বাচ্চা হতে লাগে এক মাসের কিছু বেশি। স্ত্রী ও পুরুষ কুড়োল সর্বোচ্চ ৪৫ দিন বাচ্চা দেখা শোনা করে। সদ্য শিকার করা খাবার এনে তা ছিঁড়ো ছোট টুকরা করে তা বাচ্চাদের খাওয়ায়।

আমি কুড়োলের বাসায় কী ধরনের খাবার আছে তা দেখার উদ্যোগ নিলাম। গাছের কাছাকাছি আসতে দেখে পাখি দু'টি আরো কাছে এসে চক্কর দিতে লাগল। বাসা দেখার ইচ্ছাটা দূর করলাম। স্থানীয়রা আশ্বস্ত করল যে তারা কুড়োলদের বিরক্ত করে না। এও জানাল কুড়োল তাদের ঘরের হাঁস-মুরগী ধরে না। অথচ অন্যান্য জলজ হাঁস, কালেম পাখি (Purple Moorhen), কাক এদেরকে গাছের আশেপাশেও ঘেঁসতে দেয় না।

ছবি: Purple moorhen- Sirajul Hossain

বসন্ত এলে বাচ্চা সহ কুড়োল এলাকা ছেড়ে চলে যায়। বছরের অবশিষ্ট সময় কাটায় ভারতের মেঘালয় আর আসামের বনাঞ্চলে।

কিছুক্ষণ পরে গোলাবাড়ি ছেড়ে হাওরের দিকে রওনা হলাম। দেড় দিনের এযাত্রায় টাঙ্গুয়ার হাওর আর আশেপাশের বিলে আরো চারটি কুড়োলের দেখা মিললো।

কুড়োল একটি বিপন্ন প্রজাতি। আমার জানামতে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ ২৫ জোড়া কুড়োল আছে। প্রায় ৫০ বছর আগে এদেশেই স্থায়ী বসবাস ছিল এদের। এখন কেবল শীতকালে পরিযায়ী হয় ডিম দেয়ার জন্য। তারপরও এমন একটি বিরল প্রজাতি এদেশে ডিম দিচ্ছে দেখে মনটা প্রশান্তিতে ভরে উঠল।

0 comments:

Post a Comment