অতিথি নয় পরিযায়ী
কয়েকদিন আগে প্রথম আলোতে একটি লেখা বের হয়েছে। লেখাটি এখানে পুন:প্রকাশ করলাম।
পরিযায়ী পাখিরা ‘বিদেশি পাখি’ নয়
ড. রেজা খান
(দুবাই চিড়িয়াখানার প্রধান)
ড. রেজা খান
(দুবাই চিড়িয়াখানার প্রধান)
পরিযায়ী পাখিকে ইংরেজিতে বলে মাইগ্রেটরি বার্ডস। এর অর্থ শীতের পাখি নয়। প্রাণীর ক্ষেত্রে মাইগ্রেশনের সঠিক অর্থ সাংবাৎসরিক পরিযায়ন। মাইগ্রেটরি পাখিকে তাই বলতে হবে পরিযায়ী পাখি। এসব পাখি ফিবছর কোনো বিশেষ ঋতুতে পৃথিবীর এক অঞ্চল থেকে অন্যত্র চলে যায়। ঋতুশেষে আবার সেখানে ফিরে আসে। এ ঘটনা প্রতিবছর কমবেশি একই সময় ঘটে চলেছে বহুকাল ধরে। কেবল পাখি নয়, কিছু প্রজাতির প্রজাপতি, হাঙর, মাছ; স্তন্যপায়ীর মধ্যে বাদুড়, চামচিকা, জেব্রা, গেজেল, ওয়াইল্ড বিস্ট, তিমি ও ডলফিনও পরিযায়ন করে।
পরিযায়ী পাখিরা সাংবৎসরিক যাতায়াত মূলত প্রজননকালীন অঞ্চল, যেমন−সাইবেরিয়া এবং অন্য শীতকালীন অঞ্চল, যেমন−সিলেটের হাওর এলাকায় সীমিত রাখে। পরিযায়ী পাখিরা নির্দিষ্ট একটি এলাকায় সব সময় না-ও যেতে পারে। যেমন−সিলেটের হাওরে না এসে চলে যেতে পারে; ধারেকাছের ভারতীয় এলাকা বা মিয়ানমারেও।
ধরুন, বামন চা পাখি বা লিট্ল স্টিন্ট সাইবেরিয়ায় প্রজননের পরপর অক্টোবরে দক্ষিণের দিকে ওড়া শুরু করে। এদের একটি দল চীন, তিব্বত, মঙ্গোলিয়া, ভারত হয়ে পৌঁছায় বাংলাদেশের নানা এলাকায়। অন্য দল চলে যায় রাশিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল ও চীন হয়ে জাপানের দিকে। এদের আরেক দল ছোটে পশ্চিম, মধ্য ও দক্ষিণ ইউরোপে, সেখান থেকে আফ্রিকার দিকে। ধারণা করা হয়, এদের কিছু অংশ ভারত হয়ে এশিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে যাত্রা করে বাংলাদেশ পেরিয়ে যায়।
পরিযায়ী পাখিরা প্রধানত শীতের সময় এলেও অনেকে এ দেশে আসে বসন্ত ও শরৎকালে। অনেকে এ দেশে আসে কেবলই গ্রীষ্ক্নে। শীতকালে পরিযায়ী পাখি বেশি চোখে পড়ে বলে সবাই এদের গয়রহ শীতের পাখি বলে ডাকে। এই ভুল সম্বোধন পরিহার করা দরকার।
পরিযায়ীদের নামবিভ্রান্তি
পাখি সম্পর্কে অজ্ঞানতার ফলে অনেকে পরিযায়ী পাখিদের ‘অতিথি পাখি’, ‘মেহমান পাখি’ বা ‘বিদেশি পাখি’ বলে আখ্যায়িত করছেন। অজ্ঞানতা এত দুর গেছে যে এক সাবেক প্রভাবশালী অর্থমন্ত্রী অতিথি পাখিরা কারও নিমন্ত্রণে আসেনি বলে সেগুলোকে মেরে খাওয়ার আহ্বান জানান!
পরিযায়ী পাখি বলতে বাংলাদেশে সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয় কেবল শীতকালে আসা হাঁস ও রাজহাঁসকে। সাধারণ মানুষ শীতকালে জনপথে বিক্রি হওয়া কালিম, ডাহুক, কোড়া ও সরালী পাখিকেও শীতের পাখি মনে করে। অথচ এসব পাখি আমাদের দেশের বাসিন্দা বা রেসিডেন্ট প্রজাতি। দেশে আবাসস্থলের অভাব হওয়ায় এরা এখন বেশির ভাগ সময় পাশের দেশ ভারত ও মিয়ানমারে কাটায়। শীতকালে এরা সেখান থেকে আমাদের জলাভুমিতে নেমে আসে। এদের কিছু নমুনা এখনো বাংলাদেশে প্রজনন করে।
পরিযায়ী নানা পাখি
গুটিকয় চিল, শকুন ও বাজ বাদ দিলে আমাদের দিবাভাগের অনেক শিকারি পাখিই পরিযায়ী। এদের মূল দল বাংলাদেশ পাড়ি দেয় শীতে। মোহনা, হর অঞ্চল ও হাওরে বৃহত্তম ইগল (ইম্পেরিয়াল ইগল), বড় ও ছোট চিত্রা ইগল (গ্রেটার ও লেসার স্পটেড ইগল), বাদামি বা খয়েরি ইগল (স্টেপি ও টওনি ইগল) ও মেছো ইগল বা অস্প্রে দেখা যায় বেশ; অন্যত্র ডোরাবুক ভুবনচিল (লাইনিয়েটেড কাইট), কাটুয়া চিল (বুটেড ইগল), বোনেলির ইগল (বোনেল্লিস ইগল), জলার চিল ও রাখালভুলানি (হ্যারিয়ার), কালো শকুন (সিনেরিয়াস বা ব্ল্যাক ভালচার), তুরমুতি ও শাহিন (ফ্যালকনস্) ইত্যাদি। নিশাচর শিকারি পাখির মধ্যে পেঁচারও কয়েকটি প্রজাতি পরিযায়ী।
বড় বড় জলাশয়, হাওর, চর, মোহনা, উপকুলীয় এলাকা ও দ্বীপাঞ্চলে হাজারে হাজারে আসত জলকবুতর, গঙ্গাকইতর, বদর বা বদরশাহর কবুতর ও গাঙচিল। সমুদ্রসীমানায় কোনো জেলেপল্লী মানেই ছিল শত শত গঙ্গাকইতরের ভিড়। জেলে নৌকা আর ট্রলারগুলোর পিছু নিত অসংখ্য গাঙচিল। শীতের প্রধান জলচর প্রজাতিগুলো হলো গঙ্গাকইতর বা বদর (ব্রাউনহেডেড গাল), কালোমাথা গঙ্গাকইতর (ব্ল্যাকহেডেড গাল), জলকবুতর (ইয়েলোলেগ্ড গাল) ও বড় জলকবুতর (প্যালাসেস গাল)। সবচেয়ে বেশি দেখা যায় গঙ্গাকইতর। ঢাকার বুড়িগঙ্গায় এদের দেখা যায় বেশ। এর পরপর আছে জলকবুতর।
শরৎ বা বসন্তেও এ দুই প্রজাতিকে মোহনা অঞ্চলে ক্বচিৎ দেখা যেতে পারে। জলকবুতর বা গঙ্গাকইতরের কোনো প্রজাতি আমাদের সীমানায় প্রজনন করে না। গাঙচিলের কিছু প্রজাতি এখনো প্রজনন করে। কিছু প্রজাতি আগে করত, এখন আর করে না।
খোঁপাযুক্ত মাঝারি গাঙচিল (লেসার ক্রেস্টেড টার্ন), খোঁপাযুক্ত বৃহৎ গাঙচিল (গ্রেটার ক্রেস্টেড টার্ন) ও বৃহৎ গাঙচিল (ক্যাস্পিয়ান টার্ন) দেখা যায় শুধু উপকুলীয় এলাকায়; মাঝারি গাঙচিল (কমন টার্ন) ও বড়ঠোঁটি গাঙচিল (গালবিল্ড টার্ন) বড় বড় জলাশয়ে। এরা সবাই আসে শীতে।
বক, কোদালি বক, কাস্তেচরা, সারস, হাড়গিলা, মদনটাক, শামুকখোল ইত্যাদির লম্বা লম্বা পা, গলা আর ঠোঁট। এদের বলা হয় ওয়েডিং বার্ডস, পানি কেটে বা ভেঙে চলা পাখি। এদের মধ্যে পরিযায়ীর দলে পড়ে কোদালি বা খুন্তেবক (স্পুনবিল), কাস্তেচরার (আইবিস) দু-একটি প্রজাতি, সারসের (স্টর্ক) সব কয়টি প্রজাতি এবং মোহনা ও জলাভুমিতে দেখতে পাওয়া ধুসর বক (গ্রে হেরন)। পরিযায়ী কাস্তেচরা ও সারস বিরল; বাকিরা সুলভ।
প্রজননকারী পরিযায়ী
চাতক, পাপিয়া, সরগম, লালপাখা কোকিল, রঙিলা চ্যাগা, ঘুরঘুর খায়েরি ও সুমচার দলকে আমরা বিবেচনা করতে পারি প্রজননকারী পরিযায়ী পাখি হিসেবে। এরা আমাদের দেশে আসে এপ্রিল-মে থেকে জুলাই-আগস্টে। এদের মধ্যে প্রথম চারটি কোকিলগোত্রীয় এবং সব কয়টিই বাসা-পরজীবী। অর্থাৎ এরা নিজেরা বাসা বানায় না, অন্য পাখির বাসায় ডিম পাড়ে। সে বাসার পালক পাখি মা-বাবা ডিমে তা দেয়। ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোলে নিজের বাচ্চা ভেবে কোকিলছানাদের খাইয়ে বড় করে। বাচ্চা বড় হয়ে নিজের রূপ ধারণ করলে পালক মা-বাবা তাদের তাড়িয়ে দেয়। পাখিরা তত দিনে মিয়ানমার বা ভারতে উড়ে যেতে সক্ষম হয়ে উঠেছে। এ ঘটনা সাংবৎসরিক। এসব কোকিল তাই পরিযায়ী পাখি। আমাদের অতি পরিচিত কালো কোকিল, চোখ গেল, সরগম ও বউ-কথা-কও পাখি স্থানীয় প্রজাতি।
আরও কত পাখি
আমরা সচরাচর দেখি না এমন অসংখ্য পরিযায়ী পাখি শরতের শেষে আসতে শুরু করে। ভরা শীতে তাদের আগমন তুঙ্গে ওঠে, ভাটা পড়ে বসন্তে। এ দলে প্রধান হলো খঞ্জনি বা ওয়াগটেইল, তুলিকা বা পিপিট, কসাইপাখি বা শ্রাইখ, ফুটকি বা পাতাফ্টুকি, লিফ ওয়ার্বলার, চটক বা ফ্লাইক্যাচার, বঘেরি, মাঠচড়াই, ধুলচড়াই বা বান্টিং, ফিনচেস ও লার্কস। দেশের যেকোনো বাগবাগিচা, উঠানের কামিনী, জবা, পাতাবাহার, জুঁই, গন্ধরাজ, গোলাপ, বাগানবিলাস, কাঠগোলাপ এবং অন্যান্য ফুল-ফলগাছের ওপর দিয়ে ও ক্ষেতখামার মাড়িয়ে চলে যায় এরা। এরা আকারে ছোট, বেশির ভাগই বাবুই-চড়ুই পাখির মতো। রং বাহারি নয় বলে আমাদের চোখেই পড়ে না। তাই ঝাঁকে ঝাঁকে আসা এসব পরিযায়ী পাখি আমাদের তালিকায়ও ঠাঁই পায় না।
এসব পাখির একটিকেও বৈজ্ঞানিকভাবে ভিনদেশি বা অতিথি পাখি বলা যাবে না। কারণ, এরা আমাদের পরিবেশব্যবস্থার অচ্ছেদ্য অংশ। শীত, গ্রীষ্ক্ন, শরৎ ও হেমন্তে আমাদের ভুখন্ড এদের পাড়ি দিতেই হবে। সময়মতো এরা ফিবছর আমাদের এখানে আসবে, সময়মতো চলেও যাবে।
এবারের শীতের পরিযায়ী
সিডরের অপ্রত্যাশিত হামলার কারণে এবার শীতে যে শতসহস্র পরিযায়ী পাখি আমাদের হাওর, বাঁওড়, বিল, চরাঞ্চল, মোহনা ও কাপ্তাই হ্রদে এসেছে; তাদের খবর ফিবছরের মতো মিডিয়ায় তেমন জায়গা করে নিতে পারেনি। সামান্য খবর যা হয়েছে, তার সবই প্রায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা সরালী হাঁস এবং একটি হাওরে পরিবেশ বিভাগের শীতকালীন পাখি গণনা নিয়ে।
সচরাচর দেখা প্রজাতিগুলোর মধ্যে ঢাকার আশপাশের বিল, দিঘি বা হ্রদের প্রায় ৯০ শতাংশই সরালী, গেছোহাঁস বা লেসার হুস্টিলিং ডাক বা ট্রি ডাক। সঙ্গে আছে দু-চারটি বড় সরালী বা ফুলভাস বা গ্রেটার হুস্টিলিং ডাক, চখাচখি, দু-একটি লেন্জা (পিনটেইল), বামুনিয়া হাঁস (কমন পোচারড্), ভুতিহাঁস (ফেরুজিনাস ডাক), বড় ভুতিহাঁস (বেয়ার’স পোচারড্), কালো হাঁস (টাফটেড ডাক), জিরিয়া হাঁস (গারগেনি), পিয়ং হাঁস (গ্যাডওয়াল), লালশির (উইজিয়ন), নীলশির (ম্যালারড্), পাতারি হাঁস (কমন টিল), পান্তামুখী বা খুন্তেহাঁস (শোভেলার) ইত্যাদি।
সরালী বাদে বাকিগুলো পরিযায়ী পাখি। এরা আমাদের মিঠা ও লোনা পানির জলাভুমিতে আসে। চলে যায় নভেম্বর থেকে মার্চের মধ্যে। তিন-চার প্রজাতির রাজহাঁস আসে কেবল শীতে; বড় বড় নদীর চরে, মোহনায়, হাওরে, কাপ্তাই হ্রদে। শাচকার একটি বড় দল দেখা যায় দেশের মোহনা ও উপকুলীয় এলাকায়। ভুতিহাঁস, পিয়ং হাঁস, লালশির, বড় ভুতিহাঁস, পান্তামুখী বা খুন্তেহাঁস, চখাচখির বড় দল দেখা যায় বড় বড় হাওর, কাপ্তাই হ্রদ ও বড় নদীতে। বোঁচা বা ঘড়াযুক্ত হাঁস (কোম্ব ডাক) মূলত স্থানীয় পাখির প্রজাতি। প্রজননের পরিবেশ লোপ পাওয়ায় এদের সংখ্যা এত কমেছে যে এরা এখন পরিযায়ীর দলে পড়ে। দেখাও যায় শীতের সময়ই বেশি।
হাঁস, সরালী, রাজহাঁস, চখাচখি বাদ দিলে আর যে বড় পাখির দলটি শীতকালে আমাদের পানিবহুল অঞ্চল দিয়ে যায় বা ওখানে কিছু সময় থাকে, ওদের আমরা জলচর বা জলাভুমির পাখি হিসেবে জানি। স্থানীয়ভাবে এদের পরিচয় চা-পাখি (স্যান্ডপাইপার স্টিন্ট), ঢেঙ্গা (শ্যাংক, স্টিল্ট), গুলিন্দা (কারলিউ), বাটান (প্লোভার), জৌরালি (গডউইট), জোয়ালা (রাফ অ্যান্ড রিভ), কাদাখোঁচা (স্মাইপ) এবং হট-টি-টি (ল্যাপউইং)। হাঁস বা রাজহাঁস দেখা যাক বা না যাক, জলাভুমির পাখির কিছু নমুনা−বিশেষ করে চা-পাখি, খঞ্জনি ও কসাই পাখি−দেখা যাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের পুকুর, থানচি, বান্দরবানের গির্জার ছোট্ট চৌবাচ্চায়।
সবার কাছে তাই আবেদন, শীতকালে দেখা বা বিভিন্ন ঋতুতে স্বল্প থেকে দীর্ঘ সময়জুড়ে বাংলাদেশে ঠাঁই নেওয়া পাখিগুলোকে অতিথি পাখি, শীতের পাখি বা বিদেশি পাখি বলে আখ্যায়িত করে তাদের যেন আমরা পর করে না ফেলি। এরা শীত, বসন্ত, শরৎ বা গ্রীষ্ক্নের পরিযায়ী পাখি। এ দেশেরই পরিযায়ী পাখি, এ দেশের প্রাণবৈচিত্র্য ও প্রাণচক্রের অচ্ছেদ্য অংশ, আমাদের জাতীয় প্রাকৃতিক বন্যপ্রাণী-সম্পদের এক বড় হিস্যা।
তথ্য নেয়া হয়েছে নিসর্গ ব্লগ থেকে। এখানে ক্লিক করে মূল লেখা পড়ুন।