জলাভূমি ও জলজ সম্পদ
Daily Ittefaq, February 6, 2007. গত শুক্রবার ২ ফেব্রম্নয়ারি ছিল বিশ্ব জলাভূমি দিবস (World wetland day)। বিশ্ব রামসার কনভেনশনের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী জলজ পরিবেশ উন্নয়নের আন্দোলন সূচিত হইয়াছিল। এই কনভেনশনের প্রণীত চুক্তিতে বিশ্বের ১৫০টি দেশ স্বাৰর করে। তন্মধ্যে বাংলাদেশও অন্যতম। বিভিন্ন দেশে বিশ্ব জলাভূমি দিবসটি পালিত হইলেও বাংলাদেশ এবারই প্রথম দিবসটির সহিত একাত্ম হইয়া পালন করিয়াছে। এ বৎসর দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিল Fish for tomorrow অর্থাৎ 'আগামীর জন্য মাছ'। জলাভূমি ও জলজ সম্পদের সঠিক ব্যবস্থাপনা, উন্নয়ন ও সংরৰণই ইহার লৰ্য।
বিশ্ব জলাভূমি দিবস উপলৰে বিভিন্ন আলোচনা-সেমিনার এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। কিন্তু অধিকাংশ আলোচনার সারবস্তু পত্র-পত্রিকায় যাহা প্রকাশিত হইয়াছে, তাহাতে আনন্দিত হইবার কিছু নাই। বিশেষজ্ঞরা বলিয়াছেন যে, গত অর্ধ শতাব্দীতে দেশের জলাভূমির পরিমাণ এক-তৃতীয়াংশে নামিয়া আসিয়াছে। অর্থাৎ জলাভূমি কমিয়াছে ৭০ ভাগ। আগে যেখানে মোট জলাভূমির পরিমাণ ছিল ৯৩ লাখ হেক্টর, বর্তমানে তাহা আসিয়া ঠেকিয়াছে ২৮ লাখ হেক্টরে। নিঃসন্দেহে ইহা একটি ভয়াবহ চিত্র। ইহার ফলে জলাশয়ের মৎস্য সম্পদসহ অন্যান্য জলজ সম্পদ কমিয়া গিয়াছে আশংকাজনকভাবে। বর্তমানে দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের মাত্র ৪০ ভাগের যোগানদার জলাভূমি। গভীরভাবে বিশেস্নষণ করিলে দেখা যায়, মূলত দুইটি কারণে এরূপ অবস্থার সৃষ্টি হইয়াছে। প্রথমতঃ প্রাকৃতিক অবৰয় ও মনুষ্যসৃষ্ট দূষণ এবং দ্বিতীয়তঃ সম্পদের অপব্যবহার। প্রাকৃতিক অবৰয়গুলির মধ্যে রহিয়াছে নদীর নাব্যতা কমে যাওয়া, জলাভূমির গভীরতা হ্রাস পাওয়া, নদী ভাঙনের কারণে পলি ভরাট হওয়া, নদীর গতিপথ বা পস্নাবনভূমির সংযোগ খাল ভরাট বা জলাভূমি সংকুচিত হইয়া যাওয়া ইত্যাদি। মনুষ্যসৃষ্ট কারণগুলি হইতেছে নদী বা বিলের পাড়ে বোরো ও অন্যান্য শস্য আবাদের ফলে জলাশয় সংকুচিত হইয়া যাওয়া, বসতভিটা তৈরির জন্য জলাশয় ভরাট করা, অপরিকল্পিত কাঁচা-পাকা রাসত্দা বা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ তৈরি করা, কৃষি জমিতে অতিমাত্রায় বিষাক্ত সার ও কীটনাশকের ব্যবহার, কল-কারখানা ও শহর-বন্দরের অপরিশোধিত বর্জ্য জলাশয়ে নিৰেপের মাধ্যমে দূষণ ইত্যাদি।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে এখন প্রায় ১২ হাজারের অধিক জলাভূমি রহিয়াছে। কিন্তু ইহার আগে এই সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। এসব জলাভূমির গুরম্নত্ব অপরিসীম। আমাদের জীবনযাত্রার বহুবিধ সম্পদ যেমন- সেচের জন্য পানি, নৌ-যোগাযোগ, গৃহনির্মাণ সামগ্রী, গবাদিপশুর খাদ্য ও চারণভূমি, বণ্যপ্রাণী ও পাখির আশ্রয়স্থল, জ্বালানি ও জৈবসার এবং সর্বোপরি গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন আহারের যোগানদার জলাভূমি। দেশের প্রায় শতকরা ৯০ ভাগ জনগোষ্ঠী কোন না কোনভাবে জীবিকা অর্জন নয়তো খাদ্যের জন্য জলাভূমির ওপর নির্ভরশীল। বলা যায়, জলাভূমিগুলি আমাদের প্রাণ। পরিবেশবান্ধব জলাভূমি একটি দেশের প্রাকৃতিক ঐতিহ্যও। অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে ইহার ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না। এ কারণে জলাশয় ভরাট করার নিয়ম অনেক দেশেই নাই। উন্নত অনেক দেশে শহরের মধ্য দিয়াই প্রবাহিত হইতেছে জলাশয়। জলাশয়গুলি বাদ দিয়াই গড়িয়া উঠিতেছে সুদৃশ্য ও বড় বড় বিল্ডিং। কেবল বাংলাদেশই বোধ হয় ইহার ব্যতিক্রম। এখানে নির্দয়ভাবে জলাশয়গুলিতে ভরাটের কাজ অব্যাহত রহিয়াছে।
দেশের জলাভূমি রৰা, সংরৰণ ও উন্নয়নের জন্য সরকারের রহিয়াছে নানা পাইলট প্রকল্প। কিন্তু ইহা সংখ্যার দিক দিয়া অপর্যাপ্ত ও অপ্রতুল। ১২ হাজার জলাভূমির মাত্র ২৬০টিতে সমাজভিত্তিক সংগঠনের মাধ্যমে জলাভূমির অবৰয় রোধ ও মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির চেষ্টা চলিতেছে। তবে ইহাও সত্য যে, রৰায় কেবল সরকার আনত্দরিক হইলেই চলিবে না, এজন্য প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন। ইহাছাড়া দেশের জলাভূমি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন নীতিমালা না থাকায় নানা সমস্যার সৃষ্টি হইতেছে। সংবিধানে কৃষি জমি, বসতবাড়ি, বনভূমি আর পতিত জমি ছাড়া কোন জলাভূমির কথা উলেস্নখ নাই। ফলে জলাভূমি সংক্রানত্দ আইনি জটিলতা ও মালিকানা নিয়া দেখা দেয় দ্বন্দ্ব। ফলে এইসব ব্যাপারে সতর্ক না হইলে যেমন প্রতিদিন জলাভূমি কমিয়া যাইবে, তেমনি দেখা দিবে মাছের আরও আকাল।
এক সময় আমরা মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধ ছিলাম বলিয়াই আমাদের মাছে-ভাতে বাঙালী বলা হইত। এখন সামুদ্রিক মাছ আহরণ ও বিদেশ হইতে মাছ আমদানি ও বিদেশী প্রজাতির মাছ চাষ করিবার প্রবণতা বাড়িয়াছে অনেক। ইহাছাড়া জলাশয়ের অভাবে মহানগর ও মফস্বল শহরগুলিতে ড্রেনেজ সিস্টেম বন্ধ হইয়া দেখা দিতেছে জলাবদ্ধতা। ফলে পরিবেশের ভারসাম্য হারানোর পাশাপাশি শহরও ক্রমশঃ হুমকির সম্মুখীন হইতেছে। অতএব জলাভূমি ও জলসম্পদের সার্বিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিই এখন সকলের কাম্য। এই দৃষ্টিতে দেশে প্রথমবারের মতো বিশ্ব জলাভূমি দিবস পালন বিশেষ অর্থবহ বলিয়া আমরা মনে করি।
0 comments:
Post a Comment