May 22, 2008

হুমকির মুখে দেশের জীববৈচিত্র্য


ঢাকা, ২২ মে (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম) - ২২ মে আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র দিবস । 'জীববৈচিত্র্য ও কৃষি' স্লোগান নিয়ে এ বছর দিবসটি পালিত হচ্ছে।

বন, জলাভূমি ও অন্যান্য আবাস নির্বিচারে ধ্বংস, চোরা শিকার, এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য চরম হুমকির মুখে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। বিস্তারিত জানাচ্ছেন মঈনুল হক চৌধুরী।

পরিবেশ অধিদপ্তরের 'জলবায়ু পরিবর্তন সেল'-এর পরামর্শক ড.শামীম আরা বেগম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, গত বছর প্রকাশিত ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) এর চতুর্থ প্রতিবেদনে দক্ষিণ এশিয়াকে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে সবচেয়ে বিপন্ন অঞ্চল হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এতে বাংলাদেশকে পৃথিবীর সবচেয়ে বিপন্ন দেশ বলা হয়েছে।

ড. শামীম আরা বেগম জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে জীববৈচিত্রের ওপর যে প্রভাব পড়বে তা হলো- বিস্তৃতিতে (ডিস্ট্রিবিউশন ও রেঞ্জ) পরিবর্তন, বিলুপ্তির মাত্রা বাড়া, প্রজননকাল বদলে যাওয়া ও গাছের ক্ষেত্রে বৃদ্ধির সময় বদলে যাওয়া।

আইপিসিসি সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে গড় বার্ষিক তাপমাত্রা গত মাত্র ১৪ বছরে (১৯৮৫-৯৮) মে মাসে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং নভেম্বর মাসে দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার প্রভাবে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় ৮ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর আবাদি জমির ক্ষতি হয়েছে। গড় বৃষ্টিপাত ও ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে । পুনরাবৃত্তি ঘটছে দীর্ঘ মেয়াদী বন্যার।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দেশের কৃষি ও জীববৈচিত্র্যে প্রভাব পড়বে সবচেয়ে বেশি। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও আবাদি জমির সঙ্কটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উজানের পানি সরবরাহও কমে যাবে আগামীতে। এতে করে আগামী ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্য সংকট মোকাবেলায় মারাত্মক রূপ নেবে।

পরিবেশ অধিদফতরের উপ-পরিচালক (আন্তর্জাতিক কনভেনশন) মির্জা শওকত আলী বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "আগামী ২০-৩০ বছরে দেশে পানি প্রবাহ কমে যাবে। উজানে চীন ও ভারত নিজেদের মরু এলাকায় পানি সরবরাহে উদ্যোগ নিচ্ছে। এতে বাংলাদেশে প্রয়োজনীয় পানি প্রবাহের অভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে কৃষি ও জীববৈচিত্র্য।"

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কতটা ব্যাপক হতে পারে দেশের নীতিনির্ধারক মহল তা অনুধাবন করছেন না মন্তব্য করে তিনি বলেন, "এখনই বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দীর্ঘমেয়াদী প্রস্তুতি নিলে ২০ কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা কেটে যাবে।"

পরিসংখ্যান ব্যুরো ও কৃষি স�প্রসারণ অধিদপ্তরের ২০০৭ সালের তথ্যমতে, দেশের মোট ফসলি জমির পরিমাণ এক কোটি ৪২ লাখ ২২ হাজার হেক্টর। এতে চাল ও গম উৎপাদন হয় সর্বোচ্চ ৩১৮ দশমিক ১৬ লাখ মেট্রিকটন।

মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট-এর মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জালাল উদ্দিন মো. শোয়েব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ইতোমধ্যে মাথাপিছু জমির পরিমাণ নেমে এসেছে দশমিক শূন্য ছয় হেক্টরে। প্রতি বছর আবাদী জমি কমছে প্রায় এক শতাংশ হারে।

তিনি বলেন, "কৃষি জমিতে বিরামহীন আবাদ ও শস্যচক্রের পন্থা অনুসরণ না করায় জমির গুণগত মানও খারাপ হয়ে গেছে যা আগামীতে বিপর্যয় ডেকে আনবে।"

বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তর জানায়, দেশে বিদ্যমান উদ্ভিদ, প্রাণী ও অনুজীবের ১০ হাজার প্রজাতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রজাতির অস্তিত্ব হুমকির মুখে। মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ডে সৃষ্ট বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের ওপর সম্ভাব্য ক্ষতিকর প্রভাবের নানা চিত্র স্পষ্ট হচ্ছে।

অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, জীববৈচিত্র্যের মধ্যে দেশে বর্তমানে ২৬৬ প্রজাতির অভ্যন্তরীণ মৎস্য, ৪৪২ প্রজাতির সামুদ্রিক মৎস্য, ২২ প্রজাতির উভচর, ১২৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ৩৮৮ প্রজাতির স্থানীয় পাখি, ২৪০ প্রজাতির অতিথি (পরিযায়ী) পাখি, ১১৩ প্রজাতির স্তন্যপায়ী ও পাঁচ হাজারের বেশি প্রজাতির প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে।

ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশ (ডব্লিউটিবি)-এর নির্বাহী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মো. আনোয়ারুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, দেশের প্রায় সোয়া ৯শ' প্রজাতির বন্যপ্রাণীর মধ্যে দেড়শ' প্রজাতিই বিলুপ্তির পথে। এছাড়া প্রায় আড়াইশ' প্রজাতির বন্যপ্রাণীর সঠিক অবস্থা সম্পর্কে রয়েছে যথার্থ তথ্যপ্রমাণের অভাব রয়েছে।

অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, "বিদ্যমান পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে যেসব প্রজাতি টিকে আছে তারা পরিবর্তিত পরিবেশে বিপন্ন। পরিবশ সংরক্ষণ ও এ সংক্রান্ত আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে মোট বন্যপ্রজাতির ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ আগামী কয়েক দশকে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।"

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. কামাল হোসাইন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, দেশের বিদ্যমান পরিবেশের সঙ্গে খাপ খেয়ে যে হাজারো প্রজাতির জীববৈচিত্র্য রয়েছে, এর অর্ধেকই কোনো না কোনো ধরনের হুমিকর সম্মুখীন। পরিবেশের ভারসাম্য বজার রাখার উদ্যোগ এখনই নিতে হবে।

ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন)'র আবাসিক প্রতিনিধি ড. আইনুন নিশাত মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "ফসলের বৈচিত্র্য বিপন্ন হওয়ার জন্য জলবায়ুর পরিবর্তন আংশিক দায়ী। আমরাও কৃষির প্রতি যত�শীল হইনি। কৃষকরা চাষের জন্য আগের মতো ধানের সঠিক জাত বাছাই করতে পারছেন না এ পরিবর্তনের কারণেই।" আগামী বিষয়টিকে মাথায় রেখেই পরিকল্পনা নিতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মির্জা শওকত আলী জানান, জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর কৌশল নির্ধারণের জন্য এরই মধ্যে কাজ চলছে। তিনি বলেন, "বিদেশী ধান বা শস্যকে প্রাধান্য না দিয়ে স্থানীয় জাতের মধ্যে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি তা চাষাবাদে উৎসাহিত করতে হবে; যেসব ফসল স্বল্প সময়ে বন্যার আগে তুলে ফেরা সম্ভব সেগুলো বেশি করে চাষাবাদ করতে হবে; লবণাক্ত এলাকায় সহনীয় ধান বা শস্যের উদ্ভাবন ও আবাদের প্রসার ঘটাতে হবে।"

বেসরকারি সংস্থা কোস্ট ট্রাস্ট-এর সা�প্রতিক এক প্রতিবেদনে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের উদ্ধৃত করে জানানো হয়, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বৃদ্ধি পেলে দেশের মোট আয়তনের ২২,৮৮৯ বর্গ কি মি তলিয়ে যেতে পারে। এর ফলে প্রায় তিন হাজার মিলিয়ন হেক্টর উর্বরা জমি তলিয়ে যাবে। এতে ২০০ মিলিয়ন টন ধানসহ গম, আখ, পাট, মটর প্রভৃতির উৎপাদন কমে যাবে। বন্যার কারণে মোট ভূ-খণ্ডের ২০ শতাংশ ক্ষতির সম্মুখীন হবে। লবণাক্ততা বৃদ্ধি দেশের ৩২ শতাংশ ভূমিকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। সুন্দরবনের ৪ লাখ ১৬ হাজার হেক্টর ভূমিসহ বনায়নকৃত বনভূমিও পর্যায়ক্রমে ধ্বংস হবে।

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কচুরিপানার ভাসমান ধাপে সবজি ও বীজতলাতে চাষাবাদ বাড়াতে হবে। যার ফলে আগাম বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করা সম্ভব হবে বলে মন্তব্য করেন বিশেষজ্ঞরা।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/এমএইচসি/টিএইচ/এমএ/১৫১৫ ঘ.

0 comments:

Post a Comment