October 19, 2008

‘মরণ-ফুল’ ফুটলে চিরবিদায় নেবে তালি পাম

তালি পামের শেষ বংশধর
পৃথিবীর একমাত্র গাছটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে?
মঞ্জরি এসেছে, ‘মরণ-ফুল’ ফুটলে চিরবিদায় নেবে তালি পাম

আনু আনোয়ার

দেখলে মনে হবে যেন তালগাছের মাথায় হরিণের শিং গজিয়েছে। আসলে তা নয়, পৃথিবীর একমাত্র বলে দাবি করা পাম জাতের একটি গাছ ‘তালি’র (বৈজ্ঞানিক নাম করিফা তালিয়েরা রক্সবার্গ) মঞ্জরিদন্ড এটি। এই গাছটি আবার রয়েছে বাংলাদেশে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে সহ-উপাচার্যের বাসভবনের পেছনে। তার চেয়েও বড় কথা হলো, এই মঞ্জরিদন্ড থেকে ফুটবে গাছটির ‘মরণ-ফুল’। ফুল থেকে হবে ফল। ফল থেকে বীজ। তারপর মারা যাবে গাছটি। অর্থাৎ আর চার-পাঁচ মাসের মধ্যেই চিরবিদায় নেবে তালি পাম নামের এই সর্বশেষ গাছটি।
পামগাছের এই প্রজাতিটি প্রথম আবিষ্ককৃত হয় ১৯১৯ সালে। ব্রিটিশ অরণ্যতরুসন্ধানী ড. উইলিয়াম রক্সবার্গ এই প্রজাতিটির প্রথম খোঁজ পান ভারতের পূর্বাঞ্চলে। তিনি এর নাম দেন করিফা তালিয়েরা (Corypha taliera)। পরে এর বৈজ্ঞানিক নাম হয় ‘করিফা তালিয়েরা রক্সবার্গ’। বাংলায় গাছটিকে ‘তালি’ বা ‘তালি পাম’ নামে ডাকা হয়। গাছটি দেখতে অবিকল আমাদের তালগাছের মতো হলেও প্রকৃতপক্ষে এটি একটি ভিন্ন প্রজাতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এই গাছটি প্রথম শনাক্ত করেন উদ্ভিদবিজ্ঞানী শ্যামল কুমার বসু (সুত্র: বিপন্ন প্রজাতির খেরোখাতা, লেখক−মোকারম হোসেন)।

গত মাসের প্রথম দিকে এ গাছের মাথা ফুঁড়ে গজিয়ে ওঠা এই মঞ্জরিটি বাংলাদেশের উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের মনে দুঃখের ছায়া ফেলে দিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মনিরুজ্জামান খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, এই মঞ্জরি থেকে আগামী দেড়-দুই মাসের মধ্যে যে ফুল ফুটবে, তা প্রকৃতপক্ষে গাছটির ‘মরণ-ফুল’, যা পরিপক্ব হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গাছটির মৃত্যু নিশ্চিত করবে। সবচেয়ে বড় কথা, পৃথিবীর বুকে প্রাকৃতিক আবাসে এটিই ছিল প্রজাতিটির একমাত্র জীবন্ত নিদর্শন, যা আগামী পাঁচ-ছয় মাসের মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

পৃথিবীতে এই প্রজাতির সর্বশেষ গাছ এটিই−বাংলাদেশের উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের এই দাবির পাশাপাশি ইন্টারনেটের উন্নুক্ত বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়াও বলছে, বন্য পরিবেশে বেড়ে ওঠা সর্বশেষ করিফা তালিয়েরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্যের বাসভবনের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।

পরিবেশ সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা−আইইউসিএন বলেছে, একই প্রজাতির আরেকটি গাছ ছিল ভারতের হাওড়ায় জাতীয় বোটানিক্যাল গার্ডেনে। তবে সেটি প্রাকৃতিক পরিবেশের নয়, উদ্যানে জন্নানো গাছ। সেটি ফুল ফোটানোর পর তার বীজ সংরক্ষণ করা হয়েছে। তবে আইইউসিএনের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রাকৃতিক পরিবেশের সর্বশেষ তালি পামটি ছিল পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনের পাশের একটি গ্রামে। গাছের মাথায় শিংয়ের মতো ফুল গজায় বলে এটিকে গ্রামের সবাই ‘ভুতের গাছ’ নাম দেয়। পরে গ্রামবাসী গাছটি কেটে ফেলে। ফলে সে গাছ থেকে কোনো বীজ সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।

বিশিষ্ট প্রকৃতিবিদ অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের করিফা তালিয়েরা প্রজাতির এটিই সর্বশেষ গাছ, সম্ভবত বিশ্বের বুকেও। কারণ, এই গাছটি নিয়ে তেমন তথ্য পাওয়া যায় না। তবে উনিশ শতকে কলকাতায় অনেকগুলো তালি পামগাছ ছিল। তিনি বলেন, এই প্রজাতির গাছ বাংলা ভুখন্ডেই একমাত্র দেখা গেছে, এ বিষয়ে বিশ্বের উদ্ভিদবিজ্ঞানীরাও একমত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের আরেকজন অধ্যাপক আবদুল আজিজ বলেন, ‘ক্যাম্পাসের গাছটির কোষ থেকে নতুন গাছ জন্নানো যায় কি না, তা পরীক্ষা করে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। এখন প্রজাতিটিকে একেবারে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য পরিপক্ব ফল সংগ্রহ করে পরবর্তী সময়ে নতুন গাছ গজানোর চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে।’

প্রথম আলো, ১৮ অক্টোবর, ২০০৮

0 comments:

Post a Comment