পার্বত্য চট্টগ্রামের অরণ্য
ফি লি প গা ই ন
একসময় পার্বত্য চট্টগ্রামের পুরোটাই ছিল অরণ্য। নিজেদের প্রয়োজনে এ বনকে তিন ভাগে ভাগ করে ২৪ শতাংশ (প্রায় আট লাখ একর) সংরক্ষিত, এক শতাংশ (প্রায় ৩৫ হাজার একর) রক্ষিত এবং ৭৫ শতাংশকে (প্রায় ২৫ লাখ একর) অশ্রেণীভুক্ত বনভুমি ঘোষণা করে ব্রিটিশরা। পাশাপাশি সংরক্ষিত বনে স্থানীয় মানুষের প্রবেশাধিকার সীমিত করে দেয় তারা। অর্থাৎ ধরন বিভিন্ন হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের পুরোটাই তখন ছিল বন। কাগজেকলমে এখনো পার্বত্য চট্টগ্রামের পুরোটাই অরণ্যভুমি। কিন্তু বাস্তবে তার কতটুকু বন সে প্রশ্ন না তোলাই ভালো। অরণ্যের সামান্যই অবশিষ্ট আছে, অধিকাংশ পাহাড়ই এখন ন্যাড়া।
চিরসবুজ বা আংশিক চিরসবুজ শ্রেণীর এ পাহাড়ি অরণ্যাঞ্চল বাংলাদেশের অন্যান্য বন থেকে একেবারেই আলাদা। এখানকার গাছপালা, পশুপাখি ও অরণ্যচারী মানুষের সঙ্গে বরং আরাকান ও পূর্ব এশিয়ার দারুণ মিল। এ বনাঞ্চলের জারুল, গামার, গর্জন, চাপালিশ, টুন, কড়ই, সিভিট, চম্পা, শিমুল, চান্দুল প্রভৃতি গাছ উচ্চতায় বিশাল। আর বাঁশ তো স্থানীয় মানুষের আবাসন ও জীবন-জীবিকার অন্যতম উপকরণ।
এ অঞ্চলের জীবজগৎও বিশেষত্বপূর্ণ। একসময় অরণ্যের সর্বত্র দেখা যেত বাইসন, সাম্বার, বার্কিং ডিয়ার, লেপার্ড, বেঙ্গল টাইগার ও প্যান্থার। সেসবের অধিকাংশই এখন আর দেখা যায় না। টিকে আছে শুধু বিশালকায় বন্য হাতি।
যখন অরণ্য ছিল তখন অরণ্যচারী পাহাড়ি মানুষ জুমিয়াদেরও জীবনে সুখ ছিল, ছিল শান্তি। তখন জুমচাষই ছিল পাহাড়িদের একমাত্র চাষপদ্ধতি। পাহাড়ে ফসল উৎপাদনের জন্য এই চাষপদ্ধতি মানানসই।
বাইরে থেকে আসা মানুষের হস্তক্ষেপ ক্রমাগত পার্বত্য চট্টগ্রামের অরণ্য ও অরণ্যচারী জাতিগোষ্ঠীর জন্য হয়ে ওঠে হুমকি। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এবং কর্ণফুলী পেপার মিল স্থাপনের মতো উন্নয়ন প্রকল্প দিয়ে শুরু পার্বত্য চট্টগ্রামের বনবিনাশের বড় আয়োজন। ষাটের দশকে নেওয়া এসব প্রকল্প কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাট অংশের অরণ্যই ধ্বংস করেনি, পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীগুলোর সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনেও ফেলেছে সুদুরপ্রসারী প্রভাব। তবে বিশাল এ উন্নয়ন প্রকল্প দুটোর শতাধিক বছর আগে থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে শুরু হয় সেগুনের চাষ। সেগুন মূল্যবান কিন্তু পরিবেশে বার্মা থেকে এনে চাষ করা সেগুনের প্রতিকুল প্রতিক্রিয়া অস্বীকার করার উপায় নেই। পাশাপাশি দেশি-বিদেশি প্রজাতি দিয়ে কৃত্রিম বনায়ন করা হচ্ছে। ১৯৫৭ সালে শুরু হওয়া পরীক্ষামূলক রাবার চাষ পরে পার্বত্য চট্টগ্রামের নানা এলাকায় সম্প্রসারিত হয়েছে। বাংলাদেশ ফরেস্ট ইন্ডাস্ট্রিজ ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে পার্বত্য চট্টগ্রামের হাজার চল্লিশেক একর জমিতে হয়েছে রাবার চাষ। এসব জায়গার অধিকাংশই ছিল পাহাড়িদের জুমচাষের জমি অথবা প্রাকৃতিক অরণ্য।
পার্বত্য বনের আরেক শত্রু পাল্পউড প্লান্টেশন। কর্ণফুলী পেপার মিলের কাঁচামাল উৎপাদনের জন্য ১৯৭৮ ও ১৯৮২ সালে রাঙামাটি ও বান্দরবানে বসানো হয়েছে দুটি পাল্পউড ডিভিশন। ডিভিশন দুটির আয়তন প্রায় সোয়া তিন লাখ একর। এখানে চাষ করা গাছ চলে যায় কর্ণফুলী পেপার মিলে। এতে যে শুধু পাহাড়িদের জুমের জমিই চলে যাচ্ছে তা নয়, পরিবেশে এর প্রতিক্রিয়াও বিরূপ। বিদেশি প্রজাতির গাছ চাষ করে নির্দিষ্ট সময় পরপর কেটে ফেললে পাল্পউড চাষের জায়গায় আর অরণ্য থাকে না।
তামাক চাষও বনবিনাশের আরেকটি কারণ। তামাক শুকাতে যে বিপুল পরিমাণ কাঠ পোড়াতে হয় তার একটি বড় অংশ আসে বন থেকে।
উন্নয়ন প্রকল্প, বহিরাগত মানুষের চাপ, বিদেশি প্রজাতির আগ্রাসন ইত্যাদি কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম তার অরণ্য-ঐতিহ্য হারিয়েছে। অবশিষ্ট যতটুকু আছে তা বিক্ষিপ্ত ও বিপন্ন। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিপন্ন অরণ্য, বিলুপ্ত প্রাণসম্পদ ও ক্ষুদ্র আদিবাসী জাতিসত্তাগুলোকে বাঁচানোর জন্য রাষ্ট্রীয় সঠিক নীতি-কৌশলের বিকল্প নেই।
-----------
প্রথম আলো ৬ জুন ২০০৮
0 comments:
Post a Comment