June 6, 2008

প্রজননকেন্দ্রেও নিরাপদে নেই বন্য প্রাণীরা


ইফতেখার মাহমুদ ও কামনাশীষ শেখর

টাঙ্গাইলের মধুপুর বনের অর্ধেকেরও বেশি এলাকা ঘুরে একটি সাপ ও হাতে গোনা কিছু পাখি ছাড়া ভিন্ন কোনো প্রাণীর দেখা মেলেনি। বড় কোনো দুর্যোগ ছাড়া সাধারণত বড় বনে এ ধরনের পরিস্িথতি হয় না। প্রাকৃতিক কারণে নয়, মানুষের জন্যই মধুপুর বন বন্য প্রাণীদের জন্য দুর্যোগপূর্ণ এলাকায় পরিণত হয়েছে। এ বনের বেশির ভাগ প্রাণীই এখন বনছাড়া। তবে বনের ভেতরের গারোদের গ্রামের পাশে মহিষ, গরু ও শুকরের পাল চড়ে বেড়াতে দেখা গেছে। এগুলো গৃহপালিত।
তবে গত বুধবার দুপুরে বন্য প্রাণী প্রজননকেন্দ্রের আশপাশে দেখা মিলল দুর্লভ প্রাণী মুখপোড়া হনুমান ও লালমুখো বানরের। কেন্দ্রে বন্দী ৫১টি মায়া হরিণের দুই-তিনটি চোখে পড়ল। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার−আইইউসিএনের বিপদাপন্ন প্রাণীদের তালিকায় এই প্রাণী তিনটির নাম আছে। সংরক্ষণের উদ্যোগ না থাকায় বাংলাদেশে এরা বিলুপ্তির পথে। বিশ্বের অনেক দেশই এই প্রাণীগুলো রক্ষায় উদ্যোগ নিয়েছে।
স্থানীয়রা জানাল, প্রাকৃতিক শালবন ধ্বংস করে কৃত্রিম আকাশমণি বাগান সৃষ্টি করায় প্রাণীদের খাদ্য-সংকট সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি বনের ভেতর দিয়ে মহাসড়ক ও বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করায় তা প্রাণীদের বসবাসের উপযোগিতা হারিয়েছে।
বনের লহুরি এলাকায় একটি বন্য প্রাণী প্রজননকেন্দ্র আছে। নামে প্রজননকেন্দ্র হলেও সেখানে প্রাণীদের প্রজনন থেমে আছে। কেন্দ্রের কাঁটাতার দেওয়া উদ্যানে ৫১টি হরিণ আছে। ১০ বছর ধরে এ সংখ্যা কমছেও না, বাড়ছেও না। মধুপুরে সহকারী বনরক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, বন বিভাগের এমন একজন কর্মকর্তা জানান, ১৯৯৯ সালে সেখানে হরিণের সংখ্যা ছিল ৫২। এখন আছে ৫১টি। কারণ জানতে চাইলে বন কর্মকর্তা আব্দুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, হরিণ বাচ্চা দিলেই বাগডাশ এসে খেয়ে ফেলে। ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এখানকার বন্য প্রাণীর সংখ্যা একই আছে বলে স্বীকার করেন তিনি।
বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের প্রধান ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ বলেন, তাঁর বিভাগ এখনো মধুপুর বনে কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করছে না। কোনো প্রকল্প পাওয়া গেলে উদ্যোগ নেওয়া হবে।
বন থেকে হারিয়ে যেতে বসা দুর্লভ প্রাণী লালমুখো বানর ও মুখপোড়া হনুমান শুধু এই প্রজননকেন্দ্রে গেলেই দেখা মিলবে। কিন্তু এদের রক্ষায় উদ্যোগ নেই বললেই চলে। পর্যটকেরা এদের খাবার দেয়। তবে এসব খাবার খেয়ে প্রায়শই প্রাণীরা নানা রোগে আক্রান্ত হয়। কিন্তু কেন্দ্রে কোনো বন্য প্রাণী চিকিৎসক নেই।
৪৪ একর জমির ওপর স্থাপিত এই কেন্দ্রে কাগজে-কলমে ৫০টি বানর ও ১৫০টি হনুমান আছে। কেন্দ্রটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করেন একজন বনকর্মী ও তিনজন বনরক্ষী।
বনের লহুরিতে একসঙ্গে মুখপোড়া হনুমান ও লালমুখো বানর দেখা গেল। লম্বা শালগাছের মগডালে বসে লেজ নাড়াচ্ছিল মুখপোড়া হনুমানটি। নিচে বসে ছিল তিনটি লালমুখো বানর। সঙ্গীসাথি ছিল ধুসর রঙের একপাল বানর। শরীরের চেয়ে লেজ বড়।
বনের পার্শ্ববর্তী জলছত্র গ্রামে থাকেন এন্থনি মাং সাং। বাড়ির পাশে বেশকিছু ফল ও ঔষধি গাছের বাগান করেছেন। তবে ফল পাকার আগেই বানর ও হনুমানের পেটে চলে যায়। বনে পর্যাপ্ত খাবার থাকায় আগে এরা গারোদের গ্রামে আসত না। বানর ও হনুমানের দল রাস্তার পাশে গাছে গাছে দোল খেত। বনের সামান্য ভেতরে গেলেই দেখা মিলত হরেক প্রজাতির সাপ, মেছো বাঘ, মায়া হরিণ, মার্বেল বিড়ালসহ নানা জাতের প্রাণীর।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি−বেলার সম্প্রতি পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, মধুপুর বন এলাকায় প্রায় ৪০ হাজার মানুষের বসতি আছে। তারা বনের ১৩ হাজার ৭১৮ একর ভুমি ব্যবহার করছে। ফলে বনের স্বাভাবিক পরিবেশ বিপন্ন হচ্ছে। শালবন ধ্বংস ও কৃত্রিম বাগান সৃষ্টি করায় বন থেকে প্রতিবছর বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদ হারিয়ে যাচ্ছে।
বেলার নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রেজোয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, বনের ওপর নির্ভরশীল আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে অংশীদারির ভিত্তিতে বন ব্যবস্থাপনা গড়ে তুললে এটি ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেত।
গত বছর বেসরকারি গবেষণা সংস্থা বারসিকের গবেষক পাভেল পার্থ মান্দিদের বননির্ভর অভিজ্ঞতায় প্রাকৃতিক শালবনের উদ্ভিদবৈচিত্র্য মূল্যায়ন ও রাষ্ট্রের উদ্যোগ বিষয়ে গবেষণা করেন। শালবনের ১০২টি বৃক্ষের ওপর জরিপ চালিয়ে তিনি দেখতে পেয়েছেন ২৯ প্রজাতির গাছ মানুষের খাদ্য, ৩০টি ঘর, তৈজস ও আসবাবপত্র নির্মাণ এবং ২০টি বন্য ও গৃহপালিত প্রাণীর খাবার হিসেবে ব্যবহূত হতো। শালবন ধ্বংস হওয়ায় মানুষের পাশাপাশি বন্য প্রাণীরাও খাদ্য-সংকটে পড়ছে। বিলুপ্ত হচ্ছে অনেক প্রজাতি।
পাভেল পার্থ প্রথম আলোকে বলেন, মস, ফার্ন, ছত্রাক, গুল্ম, শৈবাল, পরাশ্রয়ী লতা, ঔষধি গাছসহ শালবনের প্রায় ৩০০ প্রজাতি এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এগুলোর ওপর নির্ভরশীল বন্য প্রাণীও এখন বিলুপ্তির পথে।

সূত্র : প্রথম আলো ৬ জুন ২০০৮

0 comments:

Post a Comment