দেশে আশঙ্কাজনক হারে কমছে পরিযায়ী পাখি, রক্ষায় প্রয়োজন
বিডিনিউজ২৪ এর ১৩ মে খবর অনুযায়ী দেশে পরিযায়ী পাখির পরিমাণ দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। বিস্তারিত খবর নিম্নরূপ:-
মঈনুল হক চৌধুরী
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
ঢাকা, মে ১৩ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)- জলাভূমি ও বনাঞ্চল রক্ষায় উপযুক্ত ব্যবস্থাপনার অভাব ও পরিবেশগত প্রতিকূলতাসহ নানা কারণে দেশে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে। বিস্তারিত জানাচ্ছেন মঈনুল হক চৌধুরী।
পাখি বিশেষজ্ঞদের মতে, তিনশ' প্রজাতির পরিযায়ী পাখির মধ্যে শ'খানেক প্রজাতি এখন বাংলাদেশ ছেড়ে অন্যপথে পরিযায়ন করছে। দুই দশকে বিলুপ্ত হয়েছে দেশীয় (স্থানীয়) প্রজাতির অন্তত ১০ প্রজাতির পাখি। এ ছাড়া বিলুপ্তি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে আরো ৫০ প্রজাতি। এদের মধ্যে ১৯ প্রজাতি অতিবিপন্ন, ২০টি বিপন্ন ও অন্যগুলো ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় বিচরণ করছে।
তারা বলছেন, এদের সংরক্ষণে এখনই দেশের জলাভূমি ও বনাঞ্চল রক্ষা করা প্রয়োজন। সেইসঙ্গে প্রয়োজন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পরিযায়ী পাখির ফ্লাইওয়ে ট্র্যাকিং করার জন্য বিশেষ মেথডলজি ব্যবহার, আন্তঃদেশীয়, মহাদেশীয় ও আঞ্চলিক চুক্তি।
পরিযায়ী পাখি:
শীতকালে বা মাঝে মধ্যে অন্য ঋতুতে বাংলাদেশে আসা কিংবা যাত্রা পথে কিছুদিনের জন্যে বিরতি নেওয়া পাখিই মূলত পরিযায়ী পাখি। এদের মধ্যে বেশিরভাগই জলচর, সীমিতসংখ্যক বনাঞ্চলেও বিচরণ করে। স্থানীয়ভাবে কেউকেউ এদের অতিথি পাখি বলেও ডাকেন।
নেচার কনজারভেশন কমিটি (এনসিসি) জানায় পরিযায়ী পাখির মধ্যে এশিয়াটিক ড'চার্ড, স্পোনবিল এবং ওয়েডার স�প্রদায়ের ডানলিন, রাডি টার্নস্টোন, টেরেক সেন্ডপাইপার, গ্রেটেল্ড কাটলার, মার্সসেন্ড পাইপার, স্পোনবিল সেন্ডপাইপার, গ্রেটার ইয়োলো লেগ, স্পটেড রেডসেঙ্ক প্রভৃতি পরিযায়ী পাখি এখন আর বাংলাদেশে দেখা যায় না।
এ ছাড়া স্থানীয় প্রজাতির মধ্যে বেঙ্গল ফ্লোরিক্যান, ভারতীয় ময়ূর, গ্রেটহর্ন বিল, গ্রেটহর্ন আউল, আলেকজান্দ্রা প্যারাকিট, কোরাল, ওয়াটার কক, বাদি হাঁস বিলুপ্ত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা যা বললেন:
নেচার কনজারভেশন কমিটি (এনসিসি)-এর নির্বাহী পরিচালক এবং পরিবেশবাদী সাংবাদিক ও পাখি গবেষক সাজাহান সরদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "১৯৮৭ সাল থেকে অনানুষ্ঠাকিভাবে পাখিশুমারী শুরু হয়। আর আনুষ্ঠানিকভাবে শুমারী শুরু হয় ২০০২ সালে। পাখি শুমারীতে দেখা গেছে গত দুই দশকে স্থানীয় ৫০ প্রজাতির পাখি বিলুপ্তি ঝুঁকিতে এবং পরিযায়ী পাখি কমে দুইশ' প্রজাতিতে এসে ঠেকেছে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও পড়ছে জীববৈচিত্র্যে।"
পাখি বিশেষজ্ঞ ড. আলী রেজা খানের মতে, ইউরেশিয়ায় ৩শ' প্রজাতির বেশি প্রজননকারী পাখির এক তৃতীয়াংশ দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া বা আফ্রিকায় পরিযান করে। এসব পাখির এক তৃতীয়াংশ আসে বাংলাদেশে। এখানে সাইবেরিয়া থেকে কম সংখ্যক পাখি আসে, বেশিরভাগই আসে হিমালয় ও উত্তর এশিয়া থেকে।
বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী ট্রাস্টের (ডব্লিউটিবি) নির্বাহী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, "পরিয়ায়ী-স্থানীয় পাখি একটি এলাকার প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও খাদ্য পরিস্থিতির নিদের্শক হিসাবে কাজ করে। এদের আনাগোনা কমে যাওয়া মানে তাদের আবাস ও খাদ্য ঘাটতির লক্ষণ সুস্পষ্ট হয়ে উঠা। এসব পাখি যাত্রা পথে খাবার ও বিরতির জন্যে দীর্ঘদিন নির্দিষ্ট পথে চলাচল করে। খাবারের সঙ্কট হলে অন্যত্র গমন করে।"
স্থানীয় ১০ প্রজাতির পাখি পুরোপুরি বিলুপ্তির আশঙ্কা প্রকাশ করে সাজাহান সরদার জানান, গত ২০ বছরে শ'খানেক প্রজাতির বেশি পাখি রেকর্ড করা সম্ভব হয়নি। দেশের জন্য এটি একটি চরম বিপদ সংকেত।
তিনি বলেন, "পরিযায়ী পাখি সংরক্ষণে দেশের জলাভূমি ও বনাঞ্চল রক্ষা, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পরিযায়ী পাখির ফ্লাইওয়ে ট্র্যাকিং করার জন্যে বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার, আন্তঃদেশীয়, মহাদেশীয় ও আঞ্চলিক চুক্তিরও প্রয়োজন রয়েছে।"
বাংলাদেশে পরিযায়ী পাখি সম্পর্কে বিভ্রান্তি রয়েছে উল্লেখ করে সাজাহান সরদার বলেন, "অতিথি পাখি ও বার্ডফ্লু বিষয়ে সাম্প্রতিক সময়ে নেতিবাচক ধারণা দূর করে ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টিতে জনমত তৈরি করা না হলে বিভ্রান্তি আরো বাড়বে।"
সাধারণত হাঁস প্রজাতির মাধ্যমেই বার্ডফ্লু ভাইরাস সংক্রমিত হয়। তবে বার্ডফ্লু বহনে এককভাবে পরিযায়ী পাখিকে দায়ী করার বিষয়টি এখনো আন্তর্জাতিকভাবে প্রমাণিত হয়নি।
এভিয়েন ইনফ্লুয়েঞ্জা বিশেষজ্ঞ ড. কাজী এমদাদুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "পরিযায়ী পাখির আবাসস্থলগুলো চিহ্নিত করে এবং তা থেকে দেশীয় হাসঁ ও মুরগিকে নিরাপদে রাখার বিষয়ে সচেতনতা বাড়ালে কোনো ঝুঁকি থাকবে না।"
প্রাণীবিদ অধ্যাপক ড. জাকির হোসেন বলেন, "বন্যপ্রাণীদের কোনো ধরনের ক্ষতি না করে নিজেদের মতো করে থাকতে দিলেই প্রাণীও নিরাপদ থাকে, পরিবেশেও ভারসাম্য বজায় থাকে।"
শুধু পরিযায়ী পাখিই নয়, স্থানীয় পাখির আবাসস্থল নিরাপদ রাখতে উদ্যোগী ও সচেতন হলে পরিবেশ-প্রতিবেশের ভারসাম্য রক্ষা হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
পরিযায়ী পাখির নিরাপদ আবাস ও সংরক্ষণে 'পরিযায়ী পাখি: জীববৈচিত্রের দূত' এই স্লোগানে গত ১০ ও ১১ মে সারাবিশ্বে পালিত হয়েছে বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস।
0 comments:
Post a Comment