হারিয়ে যাচ্ছে উল্লুক: দুই দশকে তিন হাজার থেকে কমে ৩০০
মঈনুল হক চৌধুরী
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
ঢাকা, এপ্রিল ৩০ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)- দেশের ১০ প্রজাতির বানরের মধ্যে ৮টিই কোনো না কোনোভাবে হুমকির সম্মুখীন। এদের মধ্যে সবচেয়ে বিপন্ন উল্লুক। আকার, আকৃতি ও আচরণের কারণে সহজে দৃষ্টি কাড়ে গোরিলা কিংবা শিম্পাঞ্জির মতো দেখতে লেজহীন এই উল্লুক। তবে আশঙ্কার বিষয়- উপযুক্ত আশ্রয় ও খাদ্যাভাবে বাংলাদেশে মহাবিপন্ন প্রজাতির তালিকায় থাকা উল্লুকের টিকে থাকা দায় হয়ে পড়েছে। গত দুই দশকে এর সংখ্যা তিন হাজার থেকে কমে নেমে এসেছে ৩০০-এ।
বন্যপ্রাণীবিদদের মতে, বিশ্বব্যাপী বিপন্নপ্রায় উল্লুক বাংলাদেশে মহাবিপন্ন প্রজাতি হিসাবে চিহ্নিত। ক্রমশ এদের আবাসস্থল বিলুপ্ত হয়ে পড়ায় বানরপ্রজাতির মধ্যে সবগুলোই কোনো না কোনোভাবে হুমকির সম্মুখীন।
বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী ট্রাস্ট (ডব্লিউটিবি)- এর নির্বাহী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মো. আনোয়ারুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটককমকে জানান, গত ২০ বছরে বাংলাদেশের উল্লুকের সংখ্যা তিন হাজার থেকে কমে ৩০০-এ নেমে এসেছে।
ডব্লিউটিবি এর তথ্যমতে, বাংলাদেশেরর উত্তর-পূর্ব (বৃহত্তর সিলেট) ও দক্ষিণ-পূর্ব (চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রাম) এলাকার বন ছাড়াও ভারত (উত্তর-পূর্বাংশ), মিয়ানমার (পশ্চিমাংশ) এবং চীনে উল্লুক দেখা যায়। উল্লুক প্রামেটস্ গ্র"পের একটি হলো লেজার এপ, অন্যটি গ্রেটার এপ। আর এই গ্রেটার এপ-এর আওতায় রয়েছে শিম্পাঞ্জি, গরিলা, ওরাং।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বনাঞ্চল ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে বন্যপ্রাণীর বড় অংশই বিলুপ্তির পথে। খাদ্য ও আশ্রয়ের জন্য উল্লুক সম্পূর্ণভাবে বৃক্ষের উপর নির্ভরশীল। উল্লুক যে বনভূমিতে বাস করে তার কোনো অংশ বৃক্ষহীন হয়ে পড়লেই এদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বাধাগ্রস্ত হয়।
অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম জানান, বন স�প্রসারণে বৃক্ষচারী উল্লুকের ভূমিকা অপরিসীম।
বাংলাদেশে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান উল্লুকের অন্যতম আবাস। এছাড়া সিলেটের বড়লেখা, লাঠিটিলা, সাগরনাল, গাজীপুর টি স্টেট, চাউতলি, আদমপুর, হরিণছড়া, রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্য, সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের দিঘিনালা, বাঘাইছড়ি (সাজেক, শিজক), পাবলাখালী অভয়ারণ্য, করেরখাট, হাজারিখিল অভয়ারণ্য, বাইশারি, ব্যাঙডোবা, কর্ণফুলী, রামপাহাড় (কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান), রামু, থানচি, সাতঘর, ফাসিয়াখালী, দোপাছড়ি, সাঙ্গু, আলিকদম, রাজঘাট, ভোমারিয়াঘোনা, হিমছড়ি জাতীয় উদ্যান, ইনানি, উখিয়া (থানখালি), টেকনাফ ও আপার রিজু এলাকায় উল্লুক দেখা যায়।
বাংলাদেশে টিকে থাকা উল্লুকের মধ্যে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে প্রায় অর্ধশত এবং কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানে ৮০-৯০টি উল্লুক রয়েছে বলেও জানান আনোয়ারুল ইসলাম। তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী কোম্পানি শেভরন ত্রিমাত্রিক ভূতাত্ত্বিক জরিপ কাজ শুরু করায় সেখানকার জীববৈচিত্রে অচিরেই এর প্রভাব পড়বে বলেও মনে করেন তিনি।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব কনজারভেশন নেচার (আইইউসিএন)-এর আবাসিক প্রতিনিধি ড. আইনুন নিশাত বলেন, "আবাসস্থল ধ্বংস ও খাদ্যাভাবে প্রায় সব রকম বন্যপ্রাণীর জীবন এখন হুমকির মুখে। বেশ কিছু দুর্লভ প্রাণী ও বিপন্ন প্রজাতির আবাসস্থল হিসাবে সংরক্ষিত বনকে বিরক্ত না করলেই ভলো।"
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-এর চেয়ারম্যান আবু নাসের খান জানান, তিন হাজার চার শ' একর আয়তনের লাউয়াছড়া সংরক্ষিত জাতীয় উদ্যানে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, চার শ' প্রজাতির জীবজন্তু রয়েছে। এরমধ্যে ২৪৩ প্রজাতির পাখি, ১০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী ও উভচর প্রাণী, ১৭ প্রজাতির পোকামাকড়।
পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে �প্রতি প্রকাশিত দেশের 'পরিবেশচিত্রে' বলা হয়, বাংলাদেশে বিদ্যমান ১০ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ, প্রাণী ও অনুজীবের মধ্যে বেশিরভাগই হুমকির সম্মুখীন।
ডব্লিউটিবি এর তথ্যমতে, দেশের প্রায় সোয়া ৯ শ' প্রজাতির বন্যপ্রাণীর মধ্যে দেড় শ' প্রজাতিই বিলুপ্তির পথে। স্তন্যপায়ী, পাখি, উভচর ও সরীসৃপ প্রজাতির এসব বন্যপ্রাণীর বেশিরভাগ এখন অতিবিপন্ন, বিপন্ন ও ক্ষতিগ্রস্তের তালিকায়। এছাড়া প্রায় আড়াই শ' প্রজাতির বন্যপ্রাণীর সঠিক অবস্থান সম্পর্কে রয়েছে যথার্থ তথ্যপ্রমাণের অভাব।
গবেষণায় পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, দেশের ১০ প্রজাতির বানরের মধ্যে ৮ প্রজাতি কোনো না কোনোভাবে হুমকির মুখে। অন্য সব বন্যপ্রাণীর মধ্যে উল্লুকের আকার, আকৃতি ও আচরণে বেশ উন্নত হওয়ায় সহজে মানুষের দৃষ্টি কাড়ে গোরিলা, শিম্পাঞ্জির মতো দেখতে লেজহীন এই উল্লুক। খাদ্যের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ফল ও ডুমুর খায় উল্লুক। তবে কচিপাতা, ফুল, পোকামাকড়ও এদের অনেক প্রিয়। সকালের দিকে হা-হু শব্দ করে দলগত অবস্থান জানান দেয় এরা। বাচ্চা দেয় দুই তিন বছর পরপর। শীত ঋতুতে। বাচ্চা উল্লুকের রঙ দুধের মতো সাদা। ছয় মাসের মধ্যেই রঙ বদলে হয়ে যায় কালো। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে (৬/৭ বছর) পুরুষ কালোই থেকে যায়। আর স্ত্রী উল্লুক হলুদাভ বর্ণ ধারণ করে।
অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, "উল্লুকের আবাসভূমি রক্ষায় জাতীয় উল্লুক সংরক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন জরুরি। তাছাড়া সংরক্ষিত এলাকায় বন্যপ্রাণী ধরা, মারা, শিকার করা বা শিকারের চেষ্টা করাও দণ্ডনীয় অপরাধ- এ ব্যাপারে জন সচেতনতা বাড়াতে পদক্ষেপ নিতে হবে।"
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/এমএইচসি/এএল/এমএ/১৮৫৮ ঘ.
2 comments:
ধন্যবাদ এমন একটি ব্লগ সাইট করার জন্য। আপনি ইচ্ছে করলে নিসর্গ (www.nishorga.com)-তে লিখতে পারেন। তাহলে আমাদের প্রচেষ্টা অনেকখানি এগিয়ে যাবে। আমার মনে হয় আলাদা আলাদ কাজ না করে একসাথে কাজ করা ভালো। ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ। আপনাকেও িআমার ব্লগে নিয়মিত ভ্রমণ করার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।
Post a Comment