ওয়াইল্ডলাইফ ফার্মিং: সম্ভাবনায় বাংলাদেশ
প্রাকৃতিকভাবেই বাংলাদেশ অনেক সম্ভাবনার দেশ। তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত,শীতকাল ও গ্রীষ্মকাল সবকিছু বিবেচনা করলে আমরাও ফার্মিংয়ের ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের মত এগিয়ে যেতে পারি। এর জন্য খুব বেশী অর্থ বা অন্যান্য ইনভেস্টমেন্টের প্রয়োজন হয়না। তবে সবচেয়ে বেশী যা প্রয়োজন হয় তা হল দক্ষ মানুষের। তবে এর অভাবও অনেকটা কমিয়েছে বাংলাদেশীরা। আমরাও অনেক দূর এগিয়ে গেছি। ময়মনসিংহের ভালুকায় রেপটাইলস ফার্ম এর প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ।
ওয়াইল্ড লাইফ ফার্মিং বাংলাদেশের জন্য একেবারেই নতুন একটি বিষয়। কিন্তু বিদেশে এর জনপ্রিয়তা আকাশ ছোঁয়া। সামান্য ইনভেস্ট করেই তারা প্রচুর মুনাফা অর্জন করছে। সাপ, ব্যাঙ বা কুমিরকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে বংশবৃদ্ধির মাধ্যমে তা থেকে বিভিন্নভাবে মুনাফা অর্জনের নামই হল ওয়াল্ড লাফ ফার্মিং। এসব ফার্মিংমের মাধ্যমে একজনের ভাগ্যের চাকা সহজেই খুলে যেতে পারে। তবে সাধারণ মানুষ প্রথমেই এ ফার্মিংয়ের চিন্তা করতে পারেনা কারণ এর জন্য বেশ কিছু ট্রেনিং দরকার হয়। আমাদের দেশে আমরা প্রথমেই ব্যাঙ বা সাপের ফার্মিংয়ের চিন্তা করতে পারি। এর জন্য বেশী জায়গা বা খুব বেশী অর্থের প্রয়োজন পড়েনা। ব্যাঙ খাওয়া মুসলিম সমাজে নিষিদ্ধ কিন্তু বাইরের দেশগুলোতে ব্যাঙ দিয়ে সুস্বাদু সব খাবার তৈরী করা হয়। বিশেষ করে ইউরোপ, আমেরিকা, জাপানে এর চাহিদা ব্যাপক। আমরা এসব দেশে রপ্তানীর মাধ্যমে কম ইনভেস্টে বেশী মুনাফা অর্জন করতে পারি। সাপের ফার্মিং বিশ্বে আরও জনপ্রিয়। সাপ যেমন একদিকে উপাদেয় খাবার হিসেবে ব্যবহার হয় অন্যদিকে সাপের ভেনম থেকে এন্টিভেনমসহ হরেক রকমের ওষধ তৈরী হয়। সহজেই এ সেক্টরে একজন এগিয়ে আসতে পারে। দেশে দিন দিন কলকারখানাসহ অনেক পরিবেশ দূষণকারী ইন্ড্রাস্ট্রির সংখ্যা বেড়ে চলছে। যে কেউ সহজেই ইন্ড্রাস্ট্রি গড়ে তুলতে পারে না। এর জন্য প্রয়োজন পড়ে অনেক অর্থ সহ জনবল। আবার কেউ গড়ে তুললেও লাভের মুখ দেখতে অনেক বেগ পেতে হয়। সেক্ষেত্রে বিজ্ঞানসম্মভাবে ফার্ম করলে তা থেকে অবশ্যই লাভবান হওয়া সম্ভব।
এবার ফার্মিংয়ের ব্যবস্থাপণার কথায় আসি। কিভাবে সহজেই একটা ফার্ম গড়ে তোলা যায়। প্রথমেই আসি ব্যাঙের কথায়। ফার্মিংয়ের মাধ্যমে ব্যাঙ চাষের জন্য প্রথমেই একটা ভালো প্লানিং করতে হবে। এগুলোর মধ্যে থাকবে জায়গা সিলেকশন, প্রজাতি নির্বাচন ও ডিম কালেকশন। যে জায়গা আমরা ব্যাঙের চাষের জন্য নির্ধারণ করব তা আর্দ্র বা ভেজার সাথে ঘাস থাকলে ভালো হয়। জায়গাটির এক পাশে একটি গোলাকার ছোট্ট পুকুর থাকতে হবে। আমাদের দেশে বরিশাল, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ ব্যাঙ চাষের জন্য উপযোগী জায়গা। একহাজার ব্যাঙ চাষের জন্য ১.৫ বিঘা জমি হলে ভাল হয়। শুকনো এরিয়াতে এ জায়গার মধ্যে ৫ ফিটের একটা পুকুর করতে হবে। ৪-৫ ফিট উঁচু ওয়াল বা নেট দিয়ে এ পুকুর ঘেরাও থাকবে যেন সাপ ঢুকতে না পারে। ব্যাঙ চাষের জন্য এমন প্রজাতি নির্বাচন করতে হবে যা বাইরের দেশে ভালো ডিমান্ড আছে। বাংলাদেশে লাভজনক প্রজাতিগুলো হল- বাল ফ্রগ, ক্রিকেট ফ্রগ, গ্রীন বা স্ক্রিপার ফ্রগ। প্রজাতি নির্ধারণের পর খুব সর্তকভাবে এক্সপার্টদের দ্বারা ডিম কালেশন করতে হবে। প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম এ দু’ভাবেই ডিম কালেকশন করা যায়। বর্ষকাল অর্থাৎ মে থেকে জুলাই মাসেই ব্যাঙ ডিম দেয়। সেখান থেকে প্রাকৃতিকভাবে ডিম কালেকশন করা যায়। ব্যাঙের মেয়ে ও পুরুষ ২:১ হারে পুকুরে ছেড়ে পিটুইটারি হরমোনের মাধ্যমেও ডিম কালেকশন করা যায়। এটা বয়স্ক ব্যাঙ একটা সিজনে প্রায় তিন হাজারের মত ডিম দিতে পারে। ব্রিডিং সিজনে ব্যাঙ ও তার বাচ্চাকে ভালো খাবার দিতে হবে। সাধারণত ব্যাঙ পোকামাকড়, ছোট মাছ ও অন্যান্য প্রাণীর লার্ভা খেয়ে বেঁচে থাকে। রাতের বেলা ফার্মে বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বালিয়ে পোকাড় আগমন বাড়ানো যেতে পারে। কেঁচো ব্যাঙের একটা মূল্যবান খাবার। ফার্মের মধ্যে জৈব সার দিয়েও কেঁচোর সংখ্যা বাড়ানো যায়। ব্যাঙের বাচ্চাগুলো সাধারণত তৃণভোজী। এরা এ্যালগি ও কিছু প্লাংটন খায়। বিশ থেকে পশ্চিশ দিন তাদের এ খাবার সরবরাহ করতে হয়। ব্যাঙ তেমন কোন রোগে মারা যায় না। এর ওজন ১২০-১২৫ গ্রাম হলে সুবিধা মত সময়ে এদের ধরে রপ্তানির জন্য প্রস্তুত করতে হবে। ব্যাঙ চাষ খুব জটিল কোন বিষয় নয়। তবে অভিজ্ঞরাই এ কাজের উদ্যেগে নিতে পারে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ওয়াইল্ড লাইফ বায়োলজিস্টরা এগিয়ে আসতে পারে।
সাপের ফার্মিং ব্যাঙের চেয়ে তুলনামূলক কঠিন ও ঝুকিপূর্ণ। তবে ব্যাঙের চেযে বহুগুন বেশী লাভজনক। বিদেশের অনেক দেশে সাপের ফার্মিংটা খুবই জনপ্রিয়। ভারতেও সাপের ফার্ম আছে। আমাদের দেশে সাপের ফার্ম না থাকলেও বেদে পাড়াগুলোতে সাপ নিয়ে হরেক রকমের ব্যবসা চলে। এদেরকে ফার্মিংয়ের মত গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় কাজে লাগাতে পারে বাংলাদেশী সায়েটিস্টরা। আমাদের দেশে ৬৭টি প্রজাতির সাপ আছে। যার মধ্যে ১৫টি প্রজাতি বিষাক্ত। আর এ বিষাক্ত সাপের ফার্মই বেশী লাভজনক। সাপ খাবার খায় খুবই কম বা খাবার না পেলেও এরা দু’তিন সপ্তাহ সহজেই বেঁচে থাকে। এরা ব্যাঙ, ইদুর, টিগটিকি, গিরগিটি, মাছ ও পোকামাকড় খেয়ে বেঁচে থাকে যা প্রকৃতিতে সহজেই পাওয়া যায়। একটি সাপ ১০-৪০টি পর্যন্ত ডিম দেয়। এসব কিছু বিবেচণায় আনলে সাপ ফার্মিং থেকে সহজেই প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। সাপের ফার্মের জন্য কোন বড় জায়গার প্রয়োজন হয়না। যেহেতু সাপ শীতকালে শীতনিদ্রায় যায় কাজেই সাপ ফার্মিংয়ের জন্য সেরকম জায়গায় নির্ধারণ করতে হবে। গ্রীষ্মকালে তারা তাপ নির্গত করে। আমাদের দেশে সাপ ফামির্ংয়ের জন্য মূল্যবান প্রজাতি হল কিংকোবরা, কোবরা, কমন ক্রেইট, বানডেড ক্রেইট, রাট স্নেক ও রাসেল’স ভাইপার। এ সাপগুলোর গ্রোথ বেশী , কম রোগক্রান্ত হয় এবং বাংলাদেদেশের পরিবেশের জন্য উপযোগী। যখন সাপ বাচ্চা দিবে তখন খাবার সরবরাহটা নিয়োমিত করতে হবে। অন্যান্য সময়ে সপ্তাহে দু’বার খাবার দিলেই চলে। কিংকোবরা সাধারণত লিজার্ড খায়, কোবরা ইদুর, ব্যাঙ ও পাখির ডিমও খেতে পারে। তাই যে সাপ যে ধরণের খাবার খায় তা সেভাবেই তাদের খাবার সিলেকশন করতে হবে। সাপের কোন কোন প্রজাতি ডিম দেয় আবার কেউ কেউ বাচ্চা দেয়। কাজেই সাপের ধরণ অনুযায়ী তাদের কেয়ার নিতে হবে। যেমন কোবরা জানুয়ারী মাসে মেট করে আর বাচ্চা দেয় এপ্রিল- মে মাসে। তাদের ইনকুবিশন পিরিয়ড ৬০-৭০দিন।
সাপের ফার্মিংয়ের জন্য খুবই দক্ষ লোকের দরকার হয়। যে প্রজাতি ফার্মিংয়ের জন্য নির্বাচণ করা হবে তারা সেসব সাপের খাবার, বাসস্থান ইত্যাদি সম্বন্ধে জানবে। মেয়ে-পুরুষ সহজেই নির্ণয় করতে পারতে হবে। সাপের ফার্মে খুব সর্তকভাবে চলাফেরা করতে হবে। সব সময় এ্যান্টিভেনম কাছে রাখতে হবে। হাতে গ্লোভস পড়ে খুব সর্তকভাবে সাপের ভেনম বের করতে হবে এবং ভেনম প্রক্রিয়াকরণের ভালো ব্যবস্থাও থাকতে হবে। সাপের চামড়া খুব সর্তকভাবে ছাড়াতে হবে। তাহলেই ফার্মিংটা সাকসেসফুল হবে।
ওয়াইল্ড লাইফ ফার্মিংয়ের আর একটা গুরত্বপূর্ণ সেক্টর হল ক্রোকডাইল বা রেপটাইলস ফার্মিং। বাংলাদেশের ময়মনসিংহের ভালুকার ক্রোকডাইল ফার্মের ক্রোকডাইলগুলো বর্তমানে ডিম দেওয়া শুরু করেছে যা আমাদের দেশে ওয়াইল্ড লাইফ ফার্মিংয়ে একটা গুরত্বপূর্ণ অধ্যায় বলা যায়। এখন যে কেউ সাপ কিনবা ব্যাঙের ফার্মিংয়ের উদ্যেগ নিয়ে ফার্মিংয়ের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারে। এর ফলে একদিকে যেমন প্রচুর বৈদেমিক মুদ্রা অর্জিত হবে অন্যদিকে পরিবেশ বিপর্যয় সহজেই হ্রাস করা সম্ভব।
সূত্র: নিসর্গ.কম
0 comments:
Post a Comment