রাজধানীর ওয়ারীর নবাব স্ট্রিটের বলধা গার্ডেনের শতবর্ষ পূর্ণ হবে আগামী ডিসেম্বরে প্রকৃতিপ্রেমিক দানবীর নরেন্দ্রনারায়ণ রায় চৌধুরী অতি যত্নে ১৯০৯ সালে সাইকি ও সিবেলি নামে এ বাগানটি তৈরি করেন। শুরুতেই ৫০টিরও বেশি দেশ থেকে বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ সংগ্রহ করে আপন মহিমায় বাগানটি সাজিয়েছিলেন তিনি। আজ নানা দেশের বিরল প্রজাতির বিভিন্ন উদ্ভিদে পরিপূর্ণ এটি। বর্তমানে ৮৭ পরিবারভুক্ত ৩৩৯ বর্গের ৬৭২ প্রজাতির ১৫ হাজার উদ্ভিদ রয়েছে।
কিন্তু বলধা পরিবারে আজ আনন্দ নেই। করুণ কান্না পরিবারের বৃক্ষ, তরুলতা-সবার চোখে। শোকে বিহ্বল তারা। কারণ শতবর্ষে ফোটা দেশের একমাত্র সুগার পামটি কিছুদিনের মধ্যেই মারা যাবে। ১৯৩৯-'৪০ সালের মধ্যে জমিদার নরেন্দ্রনারায়ণ রায়ের নিজ হাতে বোনা এ গাছটি কিছুদিন হলো ফুল ফুটিয়েছে। এখন শুধু ফল হওয়ার অপেক্ষ। তাও অতি ক্ষণকালের; মাত্র এক মাস। বংশধর সৃষ্টির পর এটি পৃথিবীতে আর থাকতে চায় না। তাদের বেড়ে ওঠার পথ মসৃণ করে দিতেই অধরা থেকে বিদায় নেবে গাছটি। এটিই প্রকৃতির নিয়ম!
বলধার তত্ত্বাবধায়ক রুহুল আমিন এ প্রসঙ্গে আমার দেশকে বলেন, পামগাছটিতে এখন গাছের ডালের মতো মঞ্জুরিতে ক্রিম-সাদা ফুল ফুটেছে। ফুল ফোটার পরে গাছটি মাত্র কয়েক মাস বেঁচে থাকবে। গাছের কাণ্ডে লম্বালম্বিভাবে পাতাগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। কাণ্ডে ফাটল দেখা দিয়েছে। এখন ফাটল আরো বাড়ছে। ফুল থেকে বীজ হয়ে পেকে পরবর্তী বংশধর তৈরি করেই এটি পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে। তবে বীজগুলো সংরক্ষণ করা হবে। এরপর বোটানিক্যাল গার্ডেনে পাঠিয়ে দেয়া হবে। ইতোমধ্যে নার্সারিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তিনি জানান, গাছটি নরেন্দ্রনারায়ণের নিজের লাগানো। এর চারা বিদেশ থেকে আনা। ১৯৩৮-৪০ সালের মধ্যে এটি বোনা হলেও গাছটির বয়স হবে ৭০ বছর। এর বৃদ্ধি ও উচ্চতা দেখেও তাই মনে হয়। আমাদের দেশের নারিকেল ও সুপারিগাছের উচ্চতা দেখেও এভাবে বয়স অনুমান করা যায়।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পামগাছটি অত্যন্ত দৃঢ়। তালগাছের মতো চেরাই করে এর খুঁটি বানালে দীর্ঘস্থায়ী হয়। এমনকি মাটিতেও সমান শক্তিমান; ঘরের বরগা ও কড়ি হয়। সাগুতাল বা মচ্ছপুচ্ছ পাম (ক্যরিওটা ওরেনস), বোতল পাম বা পর্বত মহিমা (রসস্টোনিয়া রিজিয়া), তাল, নারিকেল প্রভৃতি একই পরিবারের (পামে) গাছের মতো দুর্দান্ত। বলধার দুটি অংশ সিবেলি ও সাইকি। ১৯৩৬ সালে ২৭ বছরের যত্নে সাইকির নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়। ১৯৩৮ সালে সিবেলি নির্মাণ শুরু হয়। ওয়ারীর নবাব স্ট্রিটের শেষ প্রান্তে দক্ষিণের অংশের নাম সাইকি। সিবিলি তারই মুখোমুখি নবাব স্ট্রিটের উত্তর দিকে অবস্থিত। সিবিলির উত্তর দিকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ প্রাচীন রেললাইন; বর্তমানে সেটি রাস্তা হয়ে গেছে। তার উত্তরে ২০০ গজের মধ্যে বঙ্গভবনের দক্ষিণের সীমানা দেয়াল। সিবেলির উত্তর সীমানা দেয়ালের পাশে বাগানের আদি গাছ পাম (করিফা এলাটা) গাছে ফুল ফুটেছে। প্রকৃতিপ্রেমিক নরেন্দ্রনারায়ণ সিবেলির জমি ক্রয় করেন শঙ্খনিধি পরিবারের ব্যবসায়ী লালমোহন সাহার কাছ থেকে। এটি সাহা পরিবারের বাগানবাড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এ সময়ও শঙ্খনিধি পুকুরটি ছিল বর্তমানের মতো ধাপে ধাপে বাঁধানো পাড়। এতে পুকুরের পাড়ের মাটির সঙ্গে পুকুরের জলজ প্রাণীর পরিবেশ ভারসাম্য বজায় থাকে। এ বাগানবাড়ির বিখ্যাত সূর্যঘড়িটি (সান ডায়াল) সাহা পরিবারের তৈরি। বলধার তত্ত্বাবধায়ক রুহূল আমিন জানান, জমিদার পুকুরের সঙ্গে সূর্যঘড়িটি কিনে নেন। এছাড়াও জমিদারের কেনার সময় এখানে দুটি বিখ্যাত গাছ ছিল-একটি দেশি বাদাম (টারমিনালিয়া কাটাপ্পা), অন্যটি দেশি খেজুর (ফিনিক্স সিলভেসট্রিস)। বর্তমানে এগুলো নেই। তবে তিনি দাবি করেন, বাংলাদেশে এটিই একমাত্র সুগার পাম।
বলধা ও রমনা পার্কে গভীর নলকূপ বসানো হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাগানের জন্য এটি ক্ষতিকর। এখান থেকে পানি তুলে পার্শ্ববর্তী এলাকায়ও পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রকৃতিপ্রেমিরা ছোট অগভীর নলকূপ বসিয়ে শুধু বাগানে পানি সরবরাহ করার দাবি করেছেন। বলধার দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে উঁচু ইমারতও বাগানের পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিবেলিতে দর্শক ঢোকার ব্যাপারে আরো কড়াকড়ি করা দরকার বলেও মত দিয়েছেন তারা।
জানা গেছে, বলধার মতো ব্যক্তি উদ্যোগে আরেকটি ঐতিহাসিক বাগান ছিল জামালপুরের ঈশ্বরচন্দ্র গুহের চৈতন্য নার্সারী, যা বলধার আগে ১৮৯৪ সালে শুরু হয়। কিন্তু কাজ আরম্ভ হয় তারও ১০ বছর আগে। আর এটিও সারা পৃথিবী থেকে চারা সংগ্রহের মাধ্যমে গড়ে ওঠে। বলধার নরেন্দ্রনারায়ণ এবং জামালপুরের ঈশ্বরচন্দ্র গুহ শখ করে বাগান করেন। এখান থেকে পামগাছ এনে ভিক্টোরিয়া পার্ক বা বাহাদুর শাহ পার্কে ১৯০৫ সালে বোনা হয়।
সূত্র: আমার দেশ, ২৪ এপ্রিল, ২০০৮
1 comments:
এরকম বিলুপ্তপ্রায় বৃক্ষ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানানোর জন্য ধন্যবাদ। গাছখেকোদের হাত এড়িয়ে এই দুর্লভ গাছটি বেচে যাওয়ায় ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
প্রিয় ব্লগার, সচেতন থাকার জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ।
Post a Comment